Loading..

নেতৃত্বের গল্প

০৭ ফেব্রুয়ারি , ২০২৪ ০৬:৪৫ অপরাহ্ণ

৭০ দশকে শিক্ষার হাল --মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন
শৈশব স্মৃতিঃ গ্রাম বাংলায় সন্ধায় পড়াশোনার প্রস্তুতি।
++++++++++++++++++++++
সত্তর দশকের কথা। তখনকার বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ছাত্র ছাত্রীদের বাড়িতে পড়াশোনার ধরন আজকের মত ছিল না। দেশের বেশীর ভাগ লোকজনই তখন গ্রামে বসবাস করত। গ্রামের লোকজন যারা শহরে চাকুরি করত তাদের অধিকাংশের পরিবারই তখন গ্রামে থাকত। দুই এক মাস পর পর তারা কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে আসত।
গ্রামাঞ্চলে তখন বিদ্যুত ছিলো না। ছিল কেরোসিনের কুপি আর হারিকেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তখন ছিল যথেষ্ট অনুন্নত। এখনকার মতো স্কুল গুলো ও এত কাছাকাছি ছিল না। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা তখন খালি পায়ে দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেত। কখনো কখনো তারা গ্রামের সরু মেঠো পথ ধরে বা আবার কখনো কখনো তারা ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেত। প্রায় সিংহভাগ ক্ষেত্রেই হাই স্কুলের ছাত্রীরা স্কুলে যাবার সময় ছাতা ব্যবহার করতো। প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো মোটামুটি কাছাকাছি থাকলেও হাইস্কুল গুলো ছিল বেশ দূরে দূরে। কোথাও কোথাও ছাত্র ছাত্রীদেরকে দল বেঁধে স্কুলের কোন কোন শিক্ষকের পেছনে পেছনে ও স্কুলে যেতে দেখা যেতো।
গ্রামের স্কুল গুলোতে তখন ইউনিফর্মের প্রচলন ছিল না। ছাত্র ছাত্রীরা তখন স্কুল ব্যাগ ও ব্যবহার করত না। সাধারণত ছাত্র ছাত্রীরা তাদের বই খাতা গুলো ডান হাতে রেখে গায়ের সাথে সেগুলো চেপে ধরে বা আবার কখনো কখনো এগুলো বগল দাবা করে স্কুলে যেতো। প্রাইমারি স্কুলে একেবারে নীচের ক্লাস গুলোতে লেখালেখির জন্য শ্লেট পেন্সিল ব্যবহার করা হতো। কিছুটা উপরের শ্রেণীতে শ্লেট পেন্সিলের পরিবর্তে দোয়াতের কালি আর নিব কলম ব্যবহার করা হতো। মাঝে মাঝে এমনও হতো যে দোয়াত থেকে কালি পড়ে ছাত্র ছাত্রীদের জামা কাপড় নষ্ট হয়ে যেতো। তখন গ্রাম এলাকায় ফাউন্টেন পেনের প্রচলন খুবই সীমিত পর্যায়ে ছিল এবং শীষ কলম দিয়ে পরীক্ষা দেয়া নিষিদ্ধ ছিল।
প্রাইভেট পড়ানোর তেমন প্রচলন ছিল না। তখন গ্রামে লেখাপড়া জানা লোকজনের খুবই অভাব ছিল। স্কুল গুলো বেশ দূরে দূরে থাকায় স্কুল গুলোতে দূর দূরান্ত থেকে শিক্ষক হিসেবে আগত অনেকেই গ্রামের বিভিন্ন অবস্থাপন্ন পরিবারে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকতে হত। থাকা খাওয়ার বিনিময়ে এই সমস্ত শিক্ষকরা বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে পড়াশোনা করাতেন। বাড়িতে থাকা এইসব লজিং মাস্টারদেরকে কখনো কখনো একটি পরিবার আবার কখনো কখনো পালাক্রমে বাড়ির সবগুলো পরিবার খাওয়ানোর দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কাছারি ঘর থাকত এবং মাস্টার মশাই কাছারি ঘরেই থাকতেন। একটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। অনেক সময় এমন ও দেখা যেত যে আশেপাশের কোন দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েরাও এই সমস্ত লজিং মাস্টারদের কাছে পড়তে আসতো। এই ব্যাপারে লজিং মাস্টার রাখা বাড়ির মালিক কোন রকম আপত্তি করতেন না। প্রায় সময়েই এই সমস্ত বাড়ির মালিকরা দরিদ্র পরিবারের ছাত্র ছাত্রীদেরকে তাঁদের বাড়িতে থাকা লজিং মাস্টারের কাছে পড়তে দিতেন।
ছাত্র ছাত্রীরা মক্তবে চলে যাওয়ার কারণে সকালে তেমন পড়াশোনা হতো না। ছেলে মেয়েরা সকালে স্থানীয় মক্তবে হুজুরের কাছে আরবী পড়তো। গ্রামাঞ্চলে ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশোনা মূলত শুরু হতো সন্ধ্যার পর। যে সমস্ত বাড়িতে লজিং মাস্টার থাকতো না সেই সব বাড়িতে সন্ধ্যার পর হারিকেন বা কুপি বাতি জ্বালিয়ে মাটিতে পাটি বিছিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পড়তে বসতো। যে সমস্ত বাড়িতে লজিং মাস্টার ছিল সেই সব বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সন্ধ্যার পর হারিকেন নিয়ে চলে যেতো বাড়ির কাঁচারী ঘরে। সে সময়ে গ্রামাঞ্চলে পড়াশোনার একটি নির্দিষ্ট ছন্দ দেখা যেতো। আর সেটা হলো জোরে জোরে পড়া। অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা জোরে জোরে আওয়াজ করে আর লম্বা সুর করে করে পড়তো। তখন সন্ধ্যার পর গ্রামের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলে প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে অবধারিত ভাবেই আওয়াজ ভেসে আসতো। একসাথে বেশ কয়েক জন সুর করে করে পড়ার কারণে কে কি পড়ছে সেটা অনেক সময়েই বোঝা যেত না। ছোট ছোট বাচ্চাদের এই ধরনের পড়ার কারণে মনে হতো ওরা বোধ হয় জোরে জোরে আর সুর করে করে পড়ার পারস্পারিক এক তুমুল প্রতিযোগিতায় নেমেছে। জোরে জোরে শব্দে করে পড়ার দুটো ব্যবহারিক উপযোগিতা ছিল। প্রথমত এতে ঘুম আসতো না আর দ্বিতীয়ত বড়রা বুঝতে পারতেন যে বাচ্চারা পড়ছে। সে সময় স্কুলের শিক্ষকদের দেয়া বাড়ির জন্য নির্ধারিত পাঠের অধিকাংশই পরবর্তী ক্লাসে মুখস্থ করে যেতে হতো। ‌কারন শিক্ষকরা পরদিন অবধারিত ভাবেই ছাত্র ছাত্রীদেরকে এই সমস্ত পড়া গুলো মুখস্থ বলতে বলতেন। কোন ছাত্র ছাত্রী এগুলো মুখস্থ বলতে না পারলে নিশ্চিত ভাবেই তাদেরকে শাস্তি পেতে হতো। আর তাই শিক্ষকদের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে তখনকার গ্রামাঞ্চলের ছাত্র ছাত্রীরা এই সব পড়া মুখস্থ করে ক্লাসে যেতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতো। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কাঁচারী ঘরে পড়াশুনা শেষ করে প্রায় ঘন্টা দুই পর হারিকেন নিয়ে আবারো ফিরে আসতো বাড়িতে। এরপর তারা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো।
জোরে জোরে, সুর করে করে বা একই বাক্য বার বার করে পড়ার ফলে তেমন কোনো লাভ হতো কিনা জানিনা। ‌তবে তখন একটা প্রচলিত বিশ্বাস ছিল এই যে, এভাবে পড়লে পড়া খুব তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয় আর সহজেই তা মনে থাকে। আর সেজন্যেই তখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এইভাবে পড়ার একটা রেওয়াজ প্রচলিত ছিল।
সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত গ্রামাঞ্চল তথা অজ পাড়াগাঁয়ে অভাব অনটন আর নানান প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও সে সময়ে গ্রামাঞ্চলের স্কুল গুলো থেকে অনেক ছাত্র ছাত্রী অত্যন্ত ভালো ফলাফল করে মেধা তালিকায় স্থান করে নিতো। পরিবেশ পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার কারণে আজকাল আর তেমনটি দেখা যায় না। গ্রামের স্কুল গুলো থেকে আজকাল আর ছাত্র ছাত্রীদেরকে খুব ভালো ফলাফল করতে বা মেধা তালিকায় স্থান করে নিতে ও তেমন একটা দেখা যায় না।
অথচ এখন গ্রামের স্কুলেও লেখা পড়ার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে।
All reactions:
Abdul Jalil Bhuiyan, Khorshed Alam and 6 others

আরো দেখুন