Loading..

নেতৃত্বের গল্প

১৭ ফেব্রুয়ারি , ২০২৪ ০১:১৪ পূর্বাহ্ণ

জীবনের হাল না ছাড়ার গল্প

হাল না ছাড়াই জীবন।

জীবন টিকে থাকে এক অঘোষিত যুদ্ধের সংগ্রাম করে। জীবন যুদ্ধ আর সামরিক যুদ্ধ এক নয়।প্রশিক্ষণ ছাড়া সামরিক যুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব।কিন্তু জীবন যুদ্ধের কেউই প্রশিক্ষিত নয়। তাই টিকে থাকার জন্য বেশি প্রয়োজন ধৈর্য আর কৌশল। জীবনের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে হাজার রকমের বাধা-বিপত্তি আর অদৃশ্য শত্রুতে ভরা। বাধা বিপত্তিগুলোকে সংগ্রামের মাধ্যমে মোকাবেলা করে  সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারলে জীবনের সফলতা। পৃথিবীতে প্রায় সকল মানুষের জীবনে প্রতিকূল মুহূর্ত এসে পড়ে।যারা এই প্রতিকূলতা ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করতে পেরেছে তারাই সফলতা অর্জন করেছে । প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের একটি গানে জীবনের সংজ্ঞা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে-জীবন মানে যন্ত্রণা, নয় ফুলের বিছানা/ সে কথা সহজে কেউ মানতে চায় না।এ কথা কেউ মানুক বা না মানুক কিন্তু জীবন সবসময় সাজানো ফুলের বিছানা নয়।মাঝে মধ্যেই জীবন যাত্রায় যন্ত্রণা পোহাতে হয়। পৃথিবীতে হাতে গোনা দু’একজন মানুষ বাদে অধিকাংশই যাঁরা সফল হয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগকেই যন্ত্রণা,ব্যাথা, দুঃখ, মনস্তাপ, বেদনা আর কষ্টকেই বরণ করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। এগুলো মানব শরীর ও মন দু’টোকেই সমানভাবে আক্রান্ত করে।আর যাঁরা সফল হয়েছেন তাদের বেদনাগুলো এক সময় পরাজিত হয়ে মধুর হয়েছে, তাদের বলা কথাগুলো অমর  সংগীতে রুপলাভ করেছে।

দুই বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী কবির সুমনের অনুপ্রেরণামূলক গান -‘হাল ছেড়োনা বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে, দেখা হবে তোমায়-আমায় অন্য গানের সুরে’।কোনো কোনো সময় বিপদ জীবনকে বিষিয়ে তোলে, জীবনের আলোকে নিভিয়ে দিতে চায়। এ রকম পরিস্থিতিতে কবির সুমনের এ গানের কলি ক’টি হতে আশোর বাতিঘর।এ প্রসংগে একটি গল্প বলা যেতে পারে। আকাশে কালো মেঘের গর্জন আর তুমুল ঝড়ের মধ্য দিয়ে এক তরুণী তার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। ঝড়ের তীব্রতায় ভীত সন্ত্রস্র তরুণী বাবাকে বললো গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নেই। পাশের সিট থেকে বাবা মেয়েকে সাহস যোগালেন, 'তুমি ড্রাইভ করতে থাকো। থেমো না"।কিছুদুর ড্রাইভ করার পরে তরুণী লক্ষ্য করলো তার পথের কিছু সামনে ষোলো চাকার একটা লরিসহ আরো কিছু গাড়ি রাস্তার পাশে সাইড করে থেমে যাচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে তরুণী  বাবাকে বললো, "বাবা এবার আমাদের থামতেই হবে। আশে-পাশের সবাই দেখো গাড়ি ড্রাইভ করা বন্ধ করে পথের পাশে থেমে যাচ্ছে"। কিন্তু বাবা সেই আগের মতই তার সিদ্ধান্তে অটল। হাল ছেড়োনা। এভাবে কয়েক মাইল যাবার পরে তরুণীটি আবিস্কার করলো, ঝড় থেমে গেছে এবং সূর্য্য উঠে গেছে। এবার বাবা বললেন, 'এবার গাড়ি থামিয়ে বাইরে বেরোতে পারো।'  তুমি পেছনের দিকে তাকাতে পারো এবং সেই সব মানুষদের দেখতে পারো যারা হাল ছেড়ে থেমে গিয়েছিলো।ওঁরা এখনো ঝড়ের মধ্যেই আছে। কিন্তু তুমি হাল ছাড়োনি এবং থেমে যাওনি, তাই তোমার ঝড় এখন শেষ! জীবনে চলার পথে আমরা অর্থনৈতিক, আবেগিক,পারিবারিক, সামাজিক ক্ষেত্রে নানা ধরণের ঝড়ের মুখোমুখি হই এবং ভয় পেয়ে থেমে গেলে জীবন গাড়ি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় যা আত্নবিশ্বাসে ঘাটতি বয়ে আনে। জীবনের রাস্তা রেসিং ড্রাইভের মত মসৃণ নয়। জীবনের পথ বড় বন্ধুর। চলার পথে নানা ধরণের বাধা-বিপত্তিই আসবেই, কিন্তু থেমে থাকলে ক্ষতির পরিমাণই শুধু বাড়বে। কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে আশেপাশের মানুষগুলো কিংবা সবচেয়ে কঠিন লোকটিও হালছেড়ে দিয়েছে বলেই যে আপনাকেও হাল ছাড়তে হবে এমন নয়। 

জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারের কালজয়ী গান-তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়, দুখের দহনে.....। এই অমর সংগীতের সাথে মিলে যায রবার্ট ব্রুসের কিংবদন্তী কাহিনী।তিনি একাধিকবার স্কটিশদের ঐক্যবদ্ধ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু বার বার তিনি পরাজিত হতে থাকেন।এক পর্যায়ে সবকিছু হারিয়ে একটি গুহার ভেতর আশ্রয় নেন। ক্ষুদ্র মাকড়সার জাল বোনা দেখে তিনি উপলব্ধি করেন, সফল হতে হলে হাল ছাড়া যাবে না। নির্ভুল যুদ্ধনীতি আর ভাগ্যের উপর ভর করে বিশাল আয়তনের ইংরেজ বাহিনীকে  কচুকাটা করেন রবার্ট ব্রুস। কোন কাজে সফলতা পেতে হলে অধ্যাবসায় করতে হবে, অধ্যাবসায় ছাড়া কোন কাজেই সফল হওয়া যায়না। চেষ্টা না করেই যদি হাল ছেড়ে দেই তাহলে কখনো সফলতার দ্বারে আমরা পৌঁছাতে পারবো না।

ভারতীয় জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী কুমার শানু জীবন নিয়ে গেয়েছেন কালজয়ী গান- এ জীবন কেন এতো রং বদলায়/কখনো কালোমেঘ,কখনো ঝড়োবেগ। জীবন প্রবাহ দ্বিকেন্দ্রিক; শরতের প্রকৃতির মতো কখনো সবুজ গালিচার সদৃশ, কখনোবা জীবন প্রহরে বিস্তার করে ধূসর জীর্ণতা। রোদ বৃষ্টির স্বভাবে জীবনে কোমল এবং কঠোর দুটি সময় বিদ্যমান। লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকা ।জীবনের চরম কঠিন মুহূর্তে বিপদ কাটিয়ে ওঠার জন্য ধৈর্য আর পরিশ্রমই একমাত্র সম্বল।মহান সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থার মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত সময়ের কালো মেঘ সরে গিয়ে রৌদ্র উজ্জ্বলতা আসবে তাতে কোনে সন্দেহ নেই।

 নচিকেতার গানের কথা গুলো জীবনকে চালিত করতে যোগায় নবায়নযোগ্য শক্তি - অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন।জীবন প্রসব করে চলাই জীবন/ শুধু যোগ-বিয়োগের খেলাই জীবন । প্রতিবাদ প্রতিরোধে নামাই জীবন/ লক্ষ্যে পৌছে তবে থামাই জীবন।মানুষের সবচেয়ে বড় সঙ্গী বোধ হয় একজন  মানুষ নিজেই । হোক সেটা মহাশুন্যতায় কিংবা মহাপূর্ণতায় । সুখে-দুখে,সহায়ে-অসহায়ে নিজের সাথে গল্প করতে পারটাই হল সফলতা । চরম হতাশার মাঝে একাকিত্বে বিহ্বল না হয়ে নিজেকে “অটো সাজেশান” দিয়ে টিকিয়ে রাখাটাই জীবনের সফলতা।যারা অসম্ভবকে সম্ভব করে তাঁরাই বাঁচে, আর আমরা যারা নিয়তিকে মেনে নিয়ে বাচার চেষ্টা না করে, তারা মরিয়া বাচে।

জীবনের শেষকে খুব কাছে,খুব নিবিড়ভাবে দেখেও শেষকে শুরু দিয়ে জয় করার মাঝে সফলতা । হাতাশার জীবনখোলসকে ভেঙে প্রাপ্তির জীবনে পদার্পণ করাই জীবন । মানুষের আশা মানুষের মতই সত্যি । খুব দৃঢ় আশা কখনোই বিফলে যায় না । কোন আশাই নিঃসঙ্গ নয় । কোথাও না কোথাও ভরসা আছে,থাকতেই হবে,খুঁজলে মিলবেই । আর আশা কেবল মানুষের জন্যই । খুব প্রতিকূল সময়ে মানুষ  স্রেফ আশার জোরেই বাঁচে । সেটাই হওয়া উচিত প্রতিটি জীবনের গল্প । বিপদে শক্ত মানসিক স্থিরতা অনেক রাস্তা উন্মোচন করে দেয় । এটাই প্রকৃতির নিয়ম । ধৈর্য নিয়ে কেবল খুঁজতে হয় । প্রতিকূলতাকে জয় করার প্রত্যাশা যেখানে থাকে পরিপূর্ণ প্রাপ্তিও সেখানেই থাকে । পানিতে ভেসে যাওয়া পিপীলিকার দল যেমন জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি মাত্র কাঠি বা, ঘাসের উপর নির্ভর করে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে। পানি থেকে বাঁচার জন্য দূর থেকে সাঁতরিয়ে সবাই কাঠির উপর জড়ো হয়। 

প্রতিটি মানুষই জন্মযোদ্ধা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হাজারো প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে এগুতে হয় জীবনের পথে। সমস্যায় ভেঙ্গে না পড়ে নিজের উপর আস্থা আর সৃষ্টিকর্তার উপর অপরিসীম বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সফলতা আসবেই, আসতে বাধ্য- এটাই হাল না ছাড়ার মূল কথা।

আরো দেখুন