Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

০৯ মার্চ, ২০২৪ ০৯:৪৬ অপরাহ্ণ

বৃক্ষরোপন অভিযান

বৃক্ষ ও প্রাণিকুল একে অপরের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাণীদের বেঁচে থাকার প্রধান ও মূল উপকরণ হলো অক্সিজেন, যা বৃক্ষ থেকেই উৎপন্ন ও নির্গত হয়। প্রত্যেক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে প্রাণিজগৎ কার্বন ডাই-অক্সাইড বর্জন করে। এটি এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বৃক্ষ সেই দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নিঃসরণ করে। বৃক্ষ থেকে পাওয়া অক্সিজেন গ্রহণ করেই আমরা বেঁচে থাকি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অহরহ বৃক্ষ নিধনের ফলে মানুষ নিজেরই ক্ষতি করে চলেছে। বৃক্ষরোপণের প্রতি মনোযোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি।

বৃক্ষ আমাদের পরিবেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং অন্যতম বনজসম্পদ। বৃক্ষের পাতা, ফল ও বীজ আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি। বৃক্ষ থেকে তন্তু আহরণ করে আমাদের পরিধেয় বস্ত্র প্রস্তুত করা হয়। বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত কাঠ দিয়ে আমাদের বাড়িঘর ও আসবাব তৈরি করা হয়। আমাদের অতি প্রয়োজনীয় লেখার সামগ্রী কাগজ ও পেনসিল বৃক্ষের কাঠ দিয়েই তৈরি করা হয়। বৃক্ষ পরিবেশের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করে। বৃক্ষ শুধু প্রাকৃতিক শোভাই বাড়ায় না বরং মাটির ক্ষয় রোধ করে, বন্যা প্রতিরোধ করে, ঝড় তুফানকে বাধা দিয়ে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও বৃক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। বৃক্ষ ছাড়া পৃথিবী মরুভূমিতে পরিণত হতো। জীবজগৎকে ছায়া দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ। বিস্তৃত বনাঞ্চলের বৃক্ষ জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুকে ঘনীভূত করে বৃষ্টিপাত ঘটায়। উদ্ভিদের অভাবে বৃষ্টিপাতেরও তারতম্য দেখা দেয়। বৃক্ষ বহুমূল্য বনজসম্পদ। তাই একদিকে বৃক্ষ যখন ধ্বংস করা হচ্ছে, অন্যদিকে তখন নতুন বৃক্ষের সৃষ্টি করতে হবে।

অরণ্যভূমির উপকারী বৃক্ষ মানুষের পরম উপকারের বিনিময়ে লাভ করল কৃতঘœতার চরম নিদর্শন। এ পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ, প্রকৃত ও উপকারী বন্ধু হলো বৃক্ষ। বৃক্ষের ছায়াতলেই গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। তাই বৃক্ষ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এক কথায় বৃক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাসহ নৈসর্গিক শোভাবর্ধনে বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশের দূষণ রোধ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে গাছ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে থাকে। অথচ নগরায়ণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর যন্ত্র-প্রযুক্তির মোহে অযাচিতভাবে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে, উজাড় হচ্ছে বন। ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বাড়ছে উষ্ণায়ন আর মানবসভ্যতা পড়ছে হুমকির মুখে। ঘাতকের কুঠারাঘাতে কত বনভূমি যে মরুভূমিতে পরিণত হলো তার ইয়ত্তা নেই। নগরজীবনে উখিত কার্বন ডাই-অক্সাইড, মানুষকে জটিল রোগের শিকার করে তুলছে। বৃক্ষ অনায়াসে এই বিষকে কণ্ঠে ধারণ করতে পারে, কিন্তু আমরা পারি না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন যেটা বৃক্ষই দিতে পারে। বায়ুর দূষণরোধ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি দূষণরোধে সক্ষম না হলে নগরজীবন দুরারোগ্য ব্যধিতে ছেয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়। অন্যদিকে পৃথিবীতে দেখা দেবে, বিপুল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কুমেরুর বরফ গলতে শুরু করবে। বৃক্ষহীনতায় বৃষ্টি কমবে, অতিরিক্ত সূর্যতাপে মাটি হয়ে উঠবে রুক্ষ। আফ্রিকার সুদান বা আমেরিকার আমাজান অববাহিকায় যে অসুরের পদধ্বনি ইতিমধ্যেই শুত হচ্ছে তা পৃথিবীর অন্যত্রও দেখা যাবে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে এখনই।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ুর সমতা বজায় রাখা, জমির ক্ষয়রোধ, বনজসম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সবকিছুর জন্য চাই বন। বনকে অবহেলা করা মানে নিজের উন্নতিতে আঘাত হানা। বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশে সাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই বৃক্ষরোপণ আধুনিক মানুষের জীবনে এক প্রাণপ্রদ উৎসব। দেখা গেছে, একটি বৃক্ষ যদি পঞ্চাশ বছর বাঁচে তবে তা থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকার সমপরিমাণ প্রাণদ অক্সিজেন পাওয়া যেতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট ভূখণ্ডের অন্তত শতকরা দশ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। দেরিতে হলেও এখন সরকার বুঝেছে এবং মানুষও সচেতন হয়েছে বন সংরক্ষণের ব্যাপারে। বৃক্ষরোপণ ও চারার সযত্ন পালন তাই এখন অগ্রাধিকার পেয়েছে। সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর এ ধারণের উদ্যোগের সুফল লক্ষ করা গেছে।

সুন্দরবন এলাকায় আলাদাভাবে ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছে। এ কাজে পঞ্চায়েতগুলোও বেশ সাফল্য দেখাচ্ছে। অভয়ারণ্য নিশ্চিত করেছে পশু-পাখির জীবন। বনে বাঘ ও অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যাও বাড়ছে। খাবারের জন্য জন্তুদের এখন লোকালয়ে আসার ঘটনা কমেছে। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখিরা এখানে সুখে বাসা বাঁধে। তাই আর কোনোভাবেই বনভূমির ধ্বংস নয়, এবার বনভূমির সংরক্ষণে যত্ন নিতে হবে আমাদের। বনকে অবহেলা করায় আমাদের দুর্দশা এসেছে। এখন বনকে গুরুত্ব দেওয়ায় বনও আমাদের দুহাত ভরিয়ে দিচ্ছে। প্রবাদ আছে, ‘গ্রাম ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং শহর মানুষের সৃষ্টি।’ দেখা গেছে যেখানেই মানুষ সৃষ্টির ওপর হস্তক্ষেপ করেছে সেখানেই প্রকৃতি নিয়েছে নির্মম প্রতিশোধ। সুতরাং জীবনকে সুন্দর ও সুস্থরূপে উপভোগ করতে হলে বৃক্ষের শ্যামল স্নিগ্ধ আশীর্বাদ ধারায় অবগাহন করতেই হবে। শুধু কাব্যিক বিলাস নয়, নিতান্ত বাস্তব প্রয়োজনেই বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব রয়েছে।

যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত সবার আগে। কেননা প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বৃক্ষহীন পরিবেশ জীবন ও জীবিকার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বিভিন্ন প্রকার শিল্পের উপকরণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সীমাহীন প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের বৃক্ষের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। মানুষের যা দরকারে লাগে তাই সে জোগাড় করতে চায়। মানুষের মাত্রাজ্ঞান অনেক সময় থাকে না। তাই দিন যতই যাচ্ছে বন ততই কমছে। তুলনায় সে পরিমাণে গাছ লাগানো হয়নি। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে বসেছে। বৃক্ষবিরল জীবনের অভিশাপ ও আধুনিক সভ্যতার বিজয়গৌরব বহন করে গড়ে উঠেছে। মানুষের বসতি নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতিদিন অগণিত বৃক্ষ-ছেদন করা হচ্ছে। এক একটি শহর হয়ে উঠেছে বৃক্ষলতার স্পর্শহীন পাষাণপুরী। কল-কারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় আকাশ-বাতাস কলঙ্কিত।

এর পরিণামে সভ্যতাগর্বী মানুষের জীবন জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। নগরজীবন বৃক্ষবিরল হয়ে আসায় মানুষের প্রাণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তাই বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীতা অপরিসীম। দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের প্রত্যেকের প্রতি বছর অন্তত দুটি করে বৃক্ষরোপণ করা দরকার। তাই এই সম্পদের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি পূরণের জন্য লাগামহীন বৃক্ষনিধন বন্ধ করা দরকার। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ জোরদার করার প্রতি আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণে অংশগ্রহণ করা। ‘আসুন গাছ লাগাই, পরিবেশ বাঁচাই’- এ স্লোগানে যদি আমরা সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করি ও গাছ লাগাই তাহলে আমাদের বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশও সুন্দর হবে।

আরো দেখুন