Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

২০ মে, ২০২৪ ০৬:০২ অপরাহ্ণ

“শিক্ষায় প্রযুক্তি আমাদের মুক্তি”- জালদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়।

শিক্ষায় বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার

দেশে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেশ আগেই শুরু হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলও অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে করোনাকালের অভিজ্ঞতা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তি ব্যবহারে আরও উদ্যোগী করেছে, যার মাধ্যমে ডিজিটাল শিক্ষার গুরুত্ব সামনে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শেখানোর ক্ষেত্রেও এখন ডিজিটাল মাধ্যমের কার্যক্রম বাড়ছে। করোনার সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। যদিও ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তির সুবিধাগুলো সবার কাছে এখনো সমানভাবে পৌঁছানো যায়নি। এ ছাড়া অনলাইন শিক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ঘাটতিও রয়েছে। 

শিক্ষাবিদ ও প্রযুক্তিবিদদের পরামর্শ হলো, ভবিষ্যমুখী শিক্ষার কথা মাথায় রেখে সবার জন্য এবং সবখানে (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি) প্রযুক্তিগত সুবিধার পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যাতে প্রযুক্তির অপব্যবহার না হয় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। 

সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। 

করোনাকালের অভিজ্ঞতা 

প্রযুক্তির প্রসার ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থা রূপান্তর হচ্ছে। শিক্ষায় এখন নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে করোনার সংক্রমণ সবাইকে নতুন ধরনের এক ‘শিক্ষা’ দিয়ে গেছে। করোনার ধাক্বায় ভয়াবহ ক্ষতি যেমন হয়েছে, আবার নতুন দিকও উন্মোচন করে দিয়েছে। করোনার সংক্রমণের প্রভাবে ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেড় বছর টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর ক্লাস বন্ধ ছিল। করোনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যেসব খাত সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। সেই ভয়ার্ত পরিবেশে ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে অনলাইনে ক্লাস করিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। যা ছিল প্রায় নতুন একটি ব্যবস্থা। কারণ, অনলাইনে অন্যান্য কাজ হলেও দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সারা দেশে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার মতো ঘটনা আগে ঘটেনি। 

করোনাকালে মূলত ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে, ইউটিউব ব্যবহার করে এবং জুম, গুগল ক্লাসরুম ও গুগল মিটের সাহায্যে ক্লাসগুলো হতো। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে পরীক্ষাও নিয়েছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পড়াশোনা শুরু হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে টেলিভিশনের মাধ্যমেও ক্লাস প্রচার করা হতো। যদিও সংসদ টিভিতে প্রচারিত রেকর্ড করা ক্লাসগুলো খুব একটা কাজে আসেনি। তুলনামূলকভাবে অনলাইনে নেওয়া ক্লাসগুলো বেশি কার্যকর ছিল। যদিও সবখানে ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় সব শিক্ষার্থী এসব ক্লাস করতে পারেনি। 

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনাকালে অনলাইনে পড়াশোনা করার যে অভ্যাস গড়ে ওঠে, তা এখন কাজে লাগছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনলাইনে অভ্যস্ত হওয়ায় সেই অভিজ্ঞতা এখন ব্যবহার করা যাচ্ছে। মূল ধারার শিক্ষার পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। 

এমন বাস্তবতায় দেশের উচ্চশিক্ষায় সশরীর এবং অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর সুযোগ রেখে একটি নীতিমালা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এটি বাস্তবায়ন করা হলে কোনো শিক্ষার্থী সশরীর পাঠ গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে রেকর্ড করা ক্লাস থেকেও লেখাপড়ার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। এ জন্য পর্যাপ্ত মাল্টিমিডিয়া কনটেন্টের (আধেয়) সুযোগ রাখার কথা আছে। মাল্টিমিডিয়া বলতে কম্পিউটারের মাধ্যমে ছবি, অডিও, ভিডিওসহ নানাভাবে পাঠদান করা হয়। 

অবশ্য করোনার আগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস হতো। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশের ২৬ হাজার ৯৫৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া আছে ৩৫ হাজার ৪৯১টি। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ সচল আছে। 

ভর্তি ও ফল প্রকাশেও ভরসা প্রযুক্তি

একটা সময় পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মতো পাবলিক পরীক্ষার ফল পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো। এ ছাড়া পরীক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ফল সংগ্রহ করত। শিক্ষা বোর্ড থেকে কেন্দ্র সচিবেরা ফল সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের জানাতেন। কিন্তু এখন আর সেসব নেই। এখন অনলাইনে ফল প্রকাশ করা হয়। শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে নির্ধারিত জায়গায় (রেজাল্ট কর্নারে) ক্লিক করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ইআইআইএন (প্রতিষ্ঠানের পরিচিত নম্বর) দিয়ে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ফল (রেজাল্ট শিট) ডাউনলোড করে। এ ছাড়া নির্ধারিত পদ্ধতিতে ওয়েবসাইটে ক্লিক করে রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়েও ফল ডাউনলোড করা যায়। আর ফলাফল প্রকাশের পর মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে মুহূর্তেই পরীক্ষার ফল জানা যায়। 

 অনলাইনে ফল জানতে মানুষ কতটা আগ্রহী, তার একটি চিত্র দেখা গেছে ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায়। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনলাইনে একযোগে এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সব কটি বোর্ডের ফল জানতে ওই দিন বেলা আড়াইটা পর্যন্ত মানুষ ১ কোটি ২০ লাখবার শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইটে ঢুকেছেন। আর ওই সময় পর্যন্ত মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠান সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ। 

কলেজগুলোতে এখন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির কাজও হয় অনলাইনে। আগে কলেজগুলো আলাদাভাবে ভর্তির কাজ করত। তখন শিক্ষার্থীদের যেমন দুর্ভোগ ছিল, তেমনি ভর্তিতে তদবির-অনিয়ম হতো। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহায়তায় অনলাইনে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির কাজটি করা হচ্ছে। প্রথম দিকে প্রযুক্তিগত কিছু জটিলতা থাকলেও এখন ঝামেলা ছাড়াই এই ভর্তির কাজটি হচ্ছে। 

এ ব্যবস্থায় নির্ধারিত একটি ওয়েবসাইটে ঢুকে সর্বনিম্ন ৫টি এবং সর্বোচ্চ ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পছন্দক্রম দিয়ে আবেদন করতে হয়। এরপর যাচাই-বাছাই করে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা (এসএসসি ও সমমানের ফল) ও পছন্দক্রম অনুযায়ী ভর্তিযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সারা দেশের বিদ্যালয়গুলোকে এখন প্রথম থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তির কাজটিও কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে হচ্ছে। করোনার সময় সব শ্রেণির জন্য এই ব্যবস্থা চালু হলেও এখন থেকে প্রতিবছরই এই প্রক্রিয়ায় ভর্তির কাজটি হবে বলে জানিয়ে আসছেন শিক্ষা বিভাগের নীতিনির্ধারকেরা। 

শুধু ভর্তি নয়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন ফিও অনলাইনে নিচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। এর পাশাপাশি বইগুলোর ডিজিটাল সংস্করণও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। ফলে প্রয়োজনে যে কেউ তা ডাউনলোড করার বা দেখার সুযোগ পান।

নতুন শিক্ষাক্রম 

এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর ধরন, মূল্যায়নসহ অনেক বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। এ জন্য গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সারা দেশের মাধ্যমিক স্তরের ৩ লাখ ২২ হাজার ১০০ শিক্ষককে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়ে জানুয়ারিতে শ্রেণিকক্ষে পাঠানো হয়। 

অল্প সময়ের (এক ঘণ্টা) ওই অনলাইন প্রশিক্ষণে শিক্ষকেরা কতটুকু জানতে পেরেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব শিক্ষককে নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে অন্তত ধারণা দিয়ে ক্লাসে পাঠানোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। তাঁদের ভাষ্য, ওই অনলাইন প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জানুয়ারিতে শিক্ষকেরা সশরীরও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন; যেটি বেশি কাজে দিচ্ছে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকেরাও এখন অনলাইনে (ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম মুক্ত পাঠ) যুক্ত হয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স করছেন। 

সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে গেছে। এটি এখন শিক্ষার অংশ। এটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

আরো দেখুন