ভ্রমণ শুধু আনন্দ উল্লাস নয় বরং আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য সচক্ষে দর্শনও বটে।
***************************************
সৃষ্টির আদি হতে মানুষ জীবন-জীবিকা কিংবা নতুন বাসস্থানের সন্ধানে সফর করে চলেছে। বর্তমান পৃথিবীতে ভ্রমণ এখন আর জীবিকা কিংবা বাসস্থানের সন্ধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং আনন্দ বিনোদন, একটু বিশ্রাম, স্বস্থির নিশ্বাসের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দিক দিগন্তে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মানুষ ভ্রমণের জন্য ছুটে চলেছে। এই ছুটে চলাটা অনেকের জীবনে নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে। সফর বর্তমান সময়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপও লাভ করেছে। অফিস আদালত, কোট কাছারীর কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, ব্যবসায়িক সমিতিও আনন্দ ভ্রমন, শিক্ষা সফর, বার্ষিক বনভোজনের নামে ভ্রমণে বের হচ্ছে।
ভ্রমণ একটি ব্যয়বহুল কষ্টসাধ্য কাজ হলেও এর মাধ্যমে মনুষ্যজাতি প্রকৃতি থেকে বাস্তব জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ পায়।
ভ্রমণ কে বিলাসী বলা হলেও এর শিক্ষামূল্য অনেক বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের গঠন, মানুষজন, প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা, মানুষের আহার বিহার, জীবন জীবিকার আয়োজন যথেষ্ট বৈচিত্রে ভরপুর হওয়াতে ভ্রমণের মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান আহরণ করা যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের গঠন বৈচিত্র্য যেমন নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ তেমনি গভীর চিন্তার উদ্রেককারীও বটে। অনেক স্থানের বিস্ময়কর গঠন শৈলী ভাবুক মনকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। তারা মহান রবের চোখ ধাঁধাঁনো সৃষ্টির রহস্যে তাঁর প্রতি সিজদাবনত হয়। মহান সৃষ্টিকর্তার সুমহান শক্তি সামর্থ্যের প্রশংসা বাক্যের গীতমালা রচনা করে মনের অজান্তে সুর লহরী তুলে ধরে গায়,
“তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর, না জানি তা হলে তুমি কত সুন্দর।”
মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করা যে তাঁর (আল্লাহর) জন্য কোন ব্যাপারই না - তা উপলব্দি করার জন্য ভ্রমণের পরামর্শমূলক নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআনের সূরা আল আনকাবূত (العنكبوت), এর ২০ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন,
قُلْ سِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَٱنظُرُوا۟ كَيْفَ بَدَأَ ٱلْخَلْقَ ثُمَّ ٱللَّهُ يُنشِئُ ٱلنَّشْأَةَ ٱلْءَاخِرَةَ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
অর্থঃ বলো -- "পৃথিবীতে তোমরা ভ্রমণ কর আর দেখ কিভাবে তিনি সৃষ্টি শুরু করেছিলেন, তারপর আল্লাহ্ পরবর্তী সৃষ্টিকে সৃজন করেন।" নিশ্চয় আল্লাহ্ সব-কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান।
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতের মাধ্যমে সামর্থ্য থাকা সাপেক্ষে পৃথিবীর আশ্চয্য সৃষ্টি দেখা যেতে পারে এবং যাতে এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি দেখে তার মহানত্ব উপলব্দি করা যায়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেমন তাঁর সৃষ্টি রহস্য দেখতে বলেছেন তেমনি দাম্ভিক, অহংকারী, অবাধ্য জাতি গোষ্টির অবাধ্যতার করুন পরিণতিও দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা আল আনআম (الانعام) এর ১১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
قُلْ سِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ ثُمَّ ٱنظُرُوا۟ كَيْفَ كَانَ عَٰقِبَةُ ٱلْمُكَذِّبِينَ
অর্থঃ বলো -- “পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো, তারপর চেয়ে দেখো কেমন হয়েছিল প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণাম।”
সূরা আন নাহল (النّحل), ৩৬ নং আয়াতে বলেন,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِى كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ ٱعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ وَٱجْتَنِبُوا۟ ٱلطَّٰغُوتَ فَمِنْهُم مَّنْ هَدَى ٱللَّهُ وَمِنْهُم مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ ٱلضَّلَٰلَةُ فَسِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَٱنظُرُوا۟ كَيْفَ كَانَ عَٰقِبَةُ ٱلْمُكَذِّبِينَ
অর্থঃ “আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মধ্যে এক-এক জন রসূল দাঁড় করেছি এই বলে -- "আল্লাহ্র উপাসনা কর এবং তাগুতকে বর্জন কর।" সুতরাং তাদের মধ্যে কতকজন আছে যাদের আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করেছেন, আর তাদের মধ্যের কতক আছে যাদের উপরে পথভ্রান্তিই সমীচীন হয়েছে। সেজন্যে পৃথিবীতে তোমরা ভ্রমণ কর এবং দেখে নাও কেমন হয়েছিল প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণাম।”
সূরা আল হাজ্জ্ব (الحجّ), ৪৬ নং আয়াতে আল্লাহ আরোও বলেন,
أَفَلَمْ يَسِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَآ أَوْ ءَاذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى ٱلْأَبْصَٰرُ وَلَٰكِن تَعْمَى ٱلْقُلُوبُ ٱلَّتِى فِى ٱلصُّدُورِ
অর্থঃ “তারা কি তবে দুনিয়াতে ভ্রমণ করে নি যার ফলে তাদের লাভ হয়েছে অন্তঃকরণ যা দিয়ে তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে অথবা কান যা দিয়ে তারা শুনতে পারে? বস্তুতঃ চোখ তো আদৌ অন্ধ নয়, কিন্তু অন্ধ হচ্ছে হৃদয় যা রয়েছে বুকের ভেতরে।”
এই সব আয়াতে কারিমা থেকে অত্যন্ত বিশ্বাসীদের একটা শিক্ষা নেওয়া দরকার যে, তারা শুধু আনন্দ উল্লাস আর বিনোদনের জন্য ভ্রমণ না করে বরং মহান আল্লাহর ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, প্রভূত্ব, রাজত্ব ইত্যাদি উপলব্দি করার মানসে ভ্রমণ করবে।
একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে বর্তমানে শিক্ষার অংশ হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর শিক্ষক শিক্ষার্থী সমেত শিক্ষা সফর করেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে পাঠের যে একগুয়েমিভাব রয়েছে তা দূর হয় তেমনি শিক্ষক শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি থেকে বাস্তব জ্ঞান লাভ করে। একটি শিক্ষা সফরে সফরকারীরা যে শুধু ভ্রমণকৃত স্থান থেকে জ্ঞান আহরণ করেন তা কিন্তু নয়। দীর্ঘ পথের আসা যাওয়ার মাঝে পথের দুই ধারের যতটুকু দেখা যায় তা থেকেও অনেক শেখার সুযোগ থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যাওয়া আসার পথে বাহিরের প্রকৃতির চারপাশ না দেখে গাড়ি বা বাহনের মধ্যে গান বাদ্য বাজনা আর হাসাহাসিতে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে চারপাশ থেকে আর শেখার সুযোগ হয়না। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে পরিমিত বিনোদনের সাথে সাথে বাহিরের চারপাশ থেকে জ্ঞান নেওয়া দরকার।
সর্বোপির, প্রিয় ভাই বন্ধু, আসুন আমরা ইসলামী তথা মুসলিম চেতনায় আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য দেখার নিয়তে ভ্রমণ করি। তাঁর বড়ত্ব কর্তৃত্বের সীমা উপলব্দি করি। তাঁর অফুরন্ত অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর সৃষ্টি রহস্য দেখার তাওফিক দান করুক।
আমিন।
মোহাম্মদ নূরুল আলম
080/2/2019