Loading..

খবর-দার

১৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০৩:৫৯ অপরাহ্ণ

“সুন্দরবনের ইতিকথা”

“সুন্দরবনের ইতিকথা”

(সুন্দরবন আমাদের ‘মা’, আসুন রক্ষা করি আমাদের রক্ষা কবচকে । এজন্য এঁর সমৃদ্ধ ইতিহাস একটু জেনে নিই ।)


পৃথিবীর সর্ব্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন । বাংলাদেশের রক্ষাকবচ ‘মা’। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে । যাকে ‘সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান’ করেছেন ইউনেস্কো । সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে সুন্দরবনের অবস্থান । হাড়িয়াভাঙ্গা, রায়মঙ্গল, কালিন্দী, শিবসা, পশুর, শেল, ভোলা অসংখ্য নদ-নদী ও খাল এই বনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত । সুন্দরবনের আয়তন দশ লক্ষ হেক্টর । বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন ৬,০০,২৩৬.৭২ হেক্টর, যার ৪,১৪,১৬৩.৩৪ হেক্টর স্থল এবং ১,৮৬,০৭৩.৩৮ হেক্টর জলাভূমি । 

লবনাক্ত এই বনের সব গাছের শ্বাসমূল থাকে । সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, বাইন, কাঁকড়া, ধুন্দল, গরান, গোলপাতা, সিংড়া, আমুর, হেনতাল, ঝানা, খালসী, বালা প্রভৃতি বৃক্ষরাজিরত সমারাহ । হরিন, শূকর, গুইশাপ, অজগর, গোখরা সহ বিভিন্ন সরীসৃপ পাওয়া যায় । সুন্দরবনের খাল এবং নদীতে রয়েছে হাঙর কুমির সহ কয়েক হাজার প্রজাতির মাছ । এবং সর্বপরী পৃথিবীখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ।


‘সুন্দরবন’ নামের উৎপত্তি : সুন্দরবন নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে । সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীগাছ । এই গাছ মানুষের কাছে বেশ পরিচিত এবং প্রয়োজনীয় । আসবাপপত্র, জ্বালানি, ঘরনির্মানে এই গাছ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং দীর্ঘস্থায়ী । সেই বহুল প্রচলিত সুন্দরীগাছ থেকে সুন্দরবনের নাম হয়েছে বলেছে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞদের মত । 

অন্যমতে, সুন্দরবনের তীর এবং বনের সর্বত্র সামদ্রিক জোয়ারে প্লাবিত করে বনকে সতেজ করে রাখে বলে, তথাকথিত এই অঞ্চলের লোকজন ‘সমুন্দরবন’ নামে ডাকত, আর এই ‘সমুদ্দুর’ বা ‘সমুন্দর’  থেকে সুন্দরবন এসেছে বলে মনে করা হয় । ‘সমুন্দরবন’ এর অপভ্রংশ সুন্দরবন । 

ইংরেজ আমলের প্রথমে বা তাঁর পূর্বে বিদেশি পর্যটকগণ সুন্দরবনের বিভিন্ন ধরনের গাছের সমাহার দেখে Jungle of Sundry Tree নামে আখ্যায়িত করেন বলে জনশ্রুতি আছে । ইংরেজি ‘Sundry’ অর্থ বিভিন্ন প্রকার । যেহেতু নানা প্রকার গাছ জন্মায় বলে ‘সানড্রি’ থেকে ‘সুন্দরী বন’ পরবর্তীতে সুন্দরবন ।

১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জের কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেকতর ইতিহাসপ্রাণ হেনরি রেভারেজ এক অন্যমত পোষণ করেন । তিনি মনে করেন, বাকেরগঞ্জের ‘সুন্দা’ নদীর নাম থেকে সুন্দরবন নাম এসেছে । কিন্তু এই যুক্তি কোনো অবস্থায় ধোপে টেকে না । 

এসব বিভিন্ন আলোচনা থেকে একটি মতামত সর্বত্রব্যাপী; সুন্দরীবৃক্ষ সুন্দরবনের সর্বত্র পাওয়া যায় । এখনো বিভিন্ন পুকুর খননের সময় এই মজবুত বৃক্ষের গুড়ি দেখতে পাওয়া যায় । শত শত বছর ধরে এই সুন্দরীগাছ সর্বত্র ছিলো । এই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উপর সুন্দরী গাছে প্রভাব ব্যাপক, এবং এর ব্যবহারও খুব বেশি । এজন্য এই বনের নাম সুন্দরবন হওয়া স্বাভাবিক ।


সুন্দরবনের ইতিহাস : সুন্দরবনের ইতিহাসের কথা আলোচনা করতে গেলে আসে এর উৎপত্তি কোথা থেকে । আর এই উৎপত্তি জানাতে গেলে আগে এই অঞ্চলের ভূতত্ত্ব ও গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ সম্পর্কে জানা থাকা প্রয়োজন । বাংলাদেশের তিন পাশের ভূ-ভাগের পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে পদ্মা ও দক্ষিণে বঙ্গোপোসাগর, সেই বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বলা হয় । এরমধ্যে পড়ে যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ এবং চব্বিশ পরগণার কলকাতা শহর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ।

হিমালয়ের গঙ্গোত্রী জলধর থেকে গঙ্গা নদীর জন্ম, যেটি ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ট নদী । যার ধারা বাংলাদেশে পদ্মা এবং মেঘনা নামে প্রবাহিত হয়েছে । হিমালয়ের তুষার হতে জলরাশিতে পর্বতরেনু বঙ্গোপোসাগরের মুখে ধাবিত হয় । আর ওই সমস্ত পর্বতরেনু পলি আকারে গঙ্গা এবং শাখা নদীর আশেপাশে ভূমি গঠন করেছে । এইভাবে শত শত বছর ধরে ‘গঙ্গা’ হিমালয় থেকে পলি নিয়ে ত্রিকোণ ভূভাগ গঠন করেছে । আর এই গঙ্গানদীর সৃষ্টি ভূভাগকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বলা হয় । 

বৈদিক যুগের পুরানে বঙ্গদেশের নাম উল্লিখিত হয়েছে । পৌরানিক গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, ভারতের বিহার প্রদেশের নাম ছিলো ‘অঙ্গ’, উড়িষ্যার নাম ছিলো ‘কলিঙ্গ’, হুগলির নাম ছিলো ‘শুন্ড’, মালদহ হতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ পর্যন্ত ভূভাগের নাম ছিলো ‘পুণ্ড’, এবং ভাগীরথীর উপকূল অঞ্চলের নাম ছিলো ‘বঙ্গ’। মহাকাব্য রামায়ন ও মহাভারতে বঙ্গদেশের নাম উল্লেখ রেয়েছে । রামায়ন বর্ণিত সীতার পৈত্রিক বাসভূমি ছিল ‘মিথিলা’ যা বঙ্গের উত্তর পশ্চিম কোনে অবস্থিত ছিলো । বর্তমানে ভারতের মালদহ জেলা এবং বাংলাদেশের রাজশাহীর একাংশ মহানন্দা নদীর পশ্চিমাংশ পর্যন্ত মিথিলার বিস্তৃতি ছিলো । 

হিমালয় থেকে আগত পলি শত শত বছর ধরে গঙ্গা ও শাখা নদীগুলোর দ্বারা প্রবাহিত পলিমাটি ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে । এবিষয়ে ভূতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকেরা সুনিশ্চিত মতামত দিয়েছেন ।

ব-দ্বীপের ধর্ম পানিকে ভূমিতে পরিনত করা । স্রোতের সাথে ধাবিত পলি মাটি সরিয়ে চর মাটি সৃষ্টি করে । সেখানে ক্রমশ বৃক্ষঅরাজির সৃষ্টি হলো । এভাবে ভাগীরথী ও পদ্মা-মেঘনা মধ্যবর্তী ভূভাগের দক্ষিণ এবং বঙ্গোপোসাগরের উত্তরে জলাবৃত্ত অঞ্চলকে সুন্দরবন বলে আখ্যায়িত করা হয় ।