Loading..

খবর-দার

২৯ জুন, ২০২০ ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ

প্রযুক্তির বিবর্তনে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম

প্রযুক্তির বিবর্তনে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম


আমরা পঠন, পাঠন, মূল্যায়ন ও শৃঙ্খলা বিধানে নতুন নতুন পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে কিছুটা স্থির হয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি হানা দিল। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে আমাদের ক্লাসে পাঠদানের ধারা বদলাতে শুরু করল, কিন্তু তাই বলে সবাই যে আধুনিক হয়ে গেছে তা বলব না। এখনও দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্বায়ত্তশাসিত বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চক অ্যান্ড টক মেথড বহাল আছে, বহাল আছে বার্ষিক পরীক্ষাও। সোমবার(২৯ জুন) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়,  তবে এখন সাধারণভাবে ক্লাসে চক্ষু ও কর্ণকে আরও জাগ্রত করার ব্যবস্থা আছে। চার্ট, ডায়াগ্রাম ব্যবহূত হচ্ছে, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর স্কুল পর্যায়েও ব্যবহূত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভাবনীয় উন্নতি ও সম্প্রসারণ এবং গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা ও ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তির আগমনে এখন অনলাইন শিক্ষা নাকি শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে। আমার (১নং প্রবন্ধকার) দশ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেণি পড়ূয়া নাতি আমার মতো পিছিয়ে পড়াদের এই করোনা ভ্যাকেশনে কম্পিউটারের কলাকৌশল ও ব্যবহারবিধি শিখিয়ে মানুষ তথা আধুনিক মানুষ বানাচ্ছে।

আমরা আগের মতো তেমন আর হাফ ইয়ারলি কিংবা বার্ষিক পরীক্ষা নিই না। অনেক জায়গায় সেমিস্টার সিস্টেম প্রবর্তিত হয়েছে। সেমিস্টার মানে ছয় মাস মেয়াদি কোর্স, ট্রাইমেস্টার সিস্টেমও পাশাপাশি চলছে, যার অর্থ চার মাস মেয়াদি কোর্স। উভয় ব্যবস্থায় শিক্ষা শুরুর আগেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই চলে যাচ্ছে, ক্লাস রুটিন তুলে দেওয়া হচ্ছে। কোনদিন কোন বিষয়ের কোন লেকচার দেওয়া হবে তাও শিক্ষার্থীরা জেনে যাচ্ছে। কবে প্রথম মিড বা দ্বিতীয় মিড টার্ম হবে এবং কবে সেমিস্টারের সমাপ্তি পরীক্ষা হবে তাও শিক্ষার্থীরা জানে। এখন ক্লাসে ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন-উত্তর, কুইজ বা ছোটখাটো রচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন হয়ে থাকে; কিন্তু হঠাৎ করে পরীক্ষা নেওয়ার দিনক্ষণ শিক্ষক ছাড়া আর কারও জানার কথা নয় বলে ক্লাসে উপস্থিতির হার পরদিনেই বেশি থাকে। এসব ছাড়াও চলমান পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে আছে মাঠ সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রতিবেদন পেশ, পঠিত বিষয়ের সময় বাঁধা প্রতিবেদন পেশ, দলগত অন্বেষা ও প্রতিবেদন পেশ, ক্লাসে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে পারে ও উপস্থাপনায় অংশ নেয়। উপস্থাপনাকে আকর্ষণীয় ও অন্যদের কাছে শিক্ষণীয় করতে আমরা স্ব-উদ্ভাবিত কিছু পদ্ধতি প্রয়োগ করছি। স্থানাভাবে তার বিস্তারিত বর্ণনা স্থগিত রাখা হলো।

পরীক্ষার ব্যাপারে আবারও কিছু কথা বলব। অনেক শিক্ষার্থী নানা অজুহাতে পরীক্ষা পেছাতে চাইত বা পরীক্ষা দিতে চাইত না। আমরা তো জানতাম বাঙালির ডান ও বাম হাত ছাড়া আরও একটি হাত আছে, যার নাম অজুহাত। আমরা এই অজুহাতের সীমিত প্রতিষেধক বের করেছিলাম। ছাত্ররা যখন পরীক্ষা দিতে অপারগতা জানাত, তখন আমরা ওপেন বুক বা খোলা বই ব্যবহারের সূচনা করলাম। এ ব্যবস্থায় প্রশ্নোত্তরে যতটা পারে বই দেখার সুযোগ ছাত্রদের দিলাম। এ ব্যবস্থায় ফল দাঁড়াল ছাত্ররা এটাকে অনেক কঠিন পরীক্ষা বিবেচনায় কমিটিং টু মেমোরি অ্যান্ড ভমিটিং ইন দ্য ক্লাসরুম প্রক্রিয়ায় ফেরত এলো।

শিক্ষায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতি একটি উদ্ভাবন বলে আমাদের মনে হয়েছে। অতীতে নাইট স্কুল বা নাইট কলেজে শিক্ষার বিকল্প হলো দূরশিক্ষণ। আমাদের দেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, এখনও আছে। পৃথিবীর বহু দেশে দূরশিক্ষায় ক্লান্ত হয়ে তারা ভার্চুয়াল শিক্ষা প্রবর্তনে লেগেছে। কোথাও তা সম্ভব না হলে (যেমন বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায়) মিশ্র পদ্ধতি চালু করেছে। এই পদ্ধতির তাত্ত্বিক বিষয়গুলো অনলাইনে আর ব্যবহারিক শিক্ষার পরীক্ষাগুলো মুখোমুখি পদ্ধতিতে নেওয়া হচ্ছে।

এ শতাব্দীর প্রথম দিকেও ভার্চুয়াল শিক্ষা, শিক্ষার্থী ভর্তি ও শিক্ষার্থী ফি আদায়, পাঠদান ও মূল্যায়ন নিয়ে বহু প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হয়েছে। সৌভাগ্য যে, একমাত্র মূল্যায়নে বিশুদ্ধতা আনা ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর চমৎকার সমাধান এসে গেছে। এখন সেশনজট আমাদের উত্তরবঙ্গের মঙ্গার মতো হয়ে গেছে, হোস্টেলে সিট নিয়ে মারামারি-কাড়াকাড়ি আর আর্থিক বিনিময় বিলোপ হবে যদি অনলাইন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। সময়ের দুষ্প্রাপ্যতার কথাও উচ্চারিত, চাকরি করে বা সন্তান লালন করে স্বামী বা স্ত্রীকে পালাক্রমে শিক্ষা বা চাকরি করতে অনলাইন শিক্ষাক্রম অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। আগেই বলেছি, বিদেশে এর বয়স অনেক দিনের। অনলাইন শিক্ষার জন্য তাদের করোনার আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।

তবে আমরা করোনাকে প্রতিহত বা আত্মস্থ করার অস্ত্র হিসেবে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্প্রতি হাত দিয়েছি। ইতোমধ্যে অনলাইন কার্যক্রমে সহায়ক গুগল থেকে শুরু করে মুডল প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মাত্র ৪৩ ভাগ ব্যবহূত হচ্ছে কিংবা ব্রডব্যান্ড সুবিধা পর্যাপ্ত অব্যবহূত রয়েছে। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমাদের বর্তমান অবস্থায় আমরা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি। অভিযোগ আছে- এ ব্যবস্থা শুধু ধনীর সন্তানের জন্য উপযোগী হলেও মানবিক স্পর্শের অনুপস্থিতিটা সবার জন্য একটা বড় বাধা। অনলাইন ব্যবস্থায় যাতে মানবিক স্পর্শ সৃষ্টি করা যায়, তার ব্যবস্থাও এসে গেছে। মিথস্ট্ক্রীয় বা অংশগ্রহণমূলক শিক্ষার কিছুটা উপকরণও তার মধ্যে সফলভাবে সংযোজিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সংকট নিরসনের কিছু উপায় চিন্তা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবস্থা হচ্ছে। বর্তমানে যা আছে তারও সদ্ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ও শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা অনেকেই বলেছেন, মূল্যায়নের গতানুগতিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা ব্যর্থ হবে; কিন্তু বিকল্প হিসেবে উপস্থাপনা, ছোট আকৃতির রচনা বা মুখোমুখি প্রশ্নের জবাব সংযোজিত হলে মূল্যায়ন সমস্যার কিছু সমাধান পাওয়া যাবে। নকল প্রবণতা বা অন্যের কাজ নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে যেসব সংস্থা শিক্ষার মান পরীক্ষা করে এবং যাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে চাকরির বাজারে চাকরিপ্রাপ্তির হেরফের ঘটছে, তারাও এই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করছে।

তবে মূল্যায়নের পদ্ধতিতে আরও উদ্ভাবনের প্রয়োজন রয়েছে। এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আপাতত দুষ্প্রাপ্য কিছু প্রশ্নের জবাবও হয়তো খুঁজে পাওয়া গেছে। তার পরও অসম্পূর্ণ থাকবে এবং করোনা স্বেচ্ছায় বা গলা ধাক্কায় বিতাড়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটিকে সয়ে নিতে হবে এবং ততদিন এটিকে প্রশ্রয় দিয়েই রাখতে হবে। অন্তত উচ্চশিক্ষালয়ে অনলাইন প্রযুক্তি দিয়ে করোনার যাতনা সহনীয় করতে হবে।

করোনা হচ্ছে একধরনের অযাচিত অতিথি, যাকে শেষমেশ গলা ধাক্কা ছাড়া বিতাড়ন সম্ভব হবে না। ভাদাইম্মা মানে অকেজো, অসমর্থ, অলস, আত্মমর্যাদাহীন, পরাশ্রয়ী ব্যক্তি; যাকে সহ্য করে করেই শেষকালে গলা ধাক্কা দিয়ে বিদায় করতে হয়। করোনাকে তাই অনাহূত অতিথির মর্যাদা দিয়ে আপাতত হোয়াট ক্যাননট বি ব্লটেড, শেল টু বি টলারেটেড জাতীয় মনোভঙ্গি ও অবস্থান নিতে হবে।

লেখকদ্বয় : ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, অধ্যাপক শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী, অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়