Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

০৩ জুলাই, ২০২০ ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

অজো পাড়ার বদলে যাওয়া এক বিদ্যালয়ের গল্প

উদ্ভাবনী গল্প

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর অজো পাড়ার বদলে

যাওয়া এক বিদ্যালয়ের গল্প

“ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়” ছোটবেলায় এই বাক্যটার উপর অনেকবার ভাবসম্প্রসারণ পরীক্ষায় লিখতে হয়েছিল। তবে বড় হয়ে আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিলাম যে, প্রচÐ ইচ্ছা শক্তি, কাজের প্রতি ভালোবাসা মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে ২০১২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বোয়ালখালী উপজেলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত দক্ষিণ কড়লডেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার যোগদান। বোয়ালখালীর প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ার দরুণ সবদিক থেকে পিছিয়ে ছিল এই বিদ্যালয়টি। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার করুণ দশার  কারণে কোন শিক্ষক বেশিদিন উক্ত বিদ্যালয়ে থাকতে চাইতেন না। সুযোগ পেলেই বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যেতেন। এখানকার সিংহভাগ মানুষ খেটে খাওয়া। পাহাড়েই কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হওয়ার কারণে পড়ালেখায় বিদ্যালয়টি ছিলো অনেক পিছিয়ে। কারণ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি এবং অভিভাবকদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু এই এলাকায় সচেতনতার অভাবে পড়ালেখার মান উন্নয়নের কাজটা বার বার বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে আসছিল। বিদ্যালয়ে যোগদান করার পর থেকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় খুব আজেবাজে মন্তব্য শোনা ছিল প্রতিদিনের রুটিন ওয়ার্কের মতো। তবে মনে মনে উপর ওয়ালাকে বলতাম তিনি যেন একটু সুযোগ করে দেন এ এলাকার মানুষগুলোর নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তনের। মহান আল্লাহতায়ালা হয়তো সেদিনের ফরিয়াদ শুনেছিলেন। সুযোগটাও পেয়ে গেলাম। তবে যে সুযোগ পেয়েছিলাম তা বাস্তবায়ন করা ছিলো খুবই কঠিন কাজ। এরপরও মনে সাহস রেখে নেমে পড়লাম কাজে। ইউনিয়ন পর্যায়ের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে বিদ্যালয়ের মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন করালাম। শুরু করলাম উপজেলা পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি। কিন্তু ছেলেদের ফুটবল হলে হয়তো কোন কটু বাক্য শুনতে হতো না। মেয়েদের যখন মাঠে অনুশীলন করাতাম তখন বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মন্তব্য হজম করতে হতো। তবুও দমে যায়নি। সবাইকে তাক লাগিয়ে এবার উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন। প্রত্যাশার পারদ উর্ধ্বগামী হলো। বিশ্বাসের বলে বলীয়ান হয়ে জেলা পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য শুরু হলো কঠোর অনুশীলন। গ্রীষ্মকালীন অবকাশে সবাই যখন এদিক সেদিক বেড়াচ্ছেন, আমি তখন বন্ধের কথা ভুলে পাহাড়ের ভেতর মাঠে শিক্ষার্থীদের অনুশীলন করানোই ব্যস্ত। কেন জানি মনে হচ্ছিল জেলা পর্যায়ে মেয়েরা সাফল্য বয়ে আনবে। জেলা পর্যায়ের প্রথম ম্যাচে জয়লাভ করলাম। এরপর দ্বিতীয় রাউন্ড, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল জিতে আমার মেয়েরা ফাইনালে উন্নীত হলো। বিশ্বাস হচ্ছিল না আসলে কি হচ্ছিল। প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল প্রাপ্তি। অজো পাড়া গাঁয়ের মেয়েরা তাদের বিদ্যালয়কে চট্টগ্রাম জেলায় পরিচিত করে দিল। ২০১৫ জেলা পর্যায়ের ফাইনালে ভালো খেলেও হেরে রানার্স আপ হলাম। চট্টগ্রাম জেলার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হলো আমার বিদ্যালয়ের ক্ষুদে মেসি তিশা। পুরো এলাকা জুড়ে আনন্দের উৎসব চলতে লাগলো। একটি মাত্র ফুটবল খেলা পাল্টে দিলো পুরো দক্ষিণ কড়লডেঙ্গা গ্রামের চিত্র। যারা এক সময় কটু কথা বলত তারা সম্মান দেয়া শুরু করলো। বিভিন্ন কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ালো। শুরু হলো বিদ্যালয়টিকে গুছানোর কাজ। দুইজন মাত্র শিক্ষক অনেক কষ্টে বিদ্যালয় চালাতে হিমশিম খেতাম। এই দুরাবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সিদ্ধান্ত নিলাম দুইজন প্যারা শিক্ষক রাখবো। যেই কথা সেই কাজ। দুইজন প্যারা শিক্ষক নিয়ে নেমে পড়লাম শিখন শেখানো কাজে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বসার চেয়ার টেবিলগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়াতে চেয়ার টেবিল যোগাড় করার কাজে সম্পৃক্ত হলাম। এলাকার যাদের মোটামুটি আর্থিক অবস্থা ভালো তাদের ডেকে চা চক্রের ব্যবস্থা করতাম। সাথে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা। এভাবে অল্পদিনেই চেয়ার, টেবিলের সমস্যা সমাধান করে ফেললাম। বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর না থাকার কারণে ক্লাস চলাকালীন সময়ে বহিরাগতদের কারণে অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় সামনের সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ করে ফেললাম। এভাবে অজো পাড়া গাঁয়ের একটা বিদ্যালয়ের চেহারা ৮ বছরে পরির্বতন হয়ে গেল। দূর থেকে কেউ বর্তমানে এই এলাকায় গেলে বিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখে প্রশংসায় ভাসায়। বিগত চার বছরে খেলাধুলায় আমার বিদ্যালয়ের সাফল্য ঈর্ষনীয়। ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্টে ইউনিয়ন পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন, ২০১৪ সালে বঙ্গমাতা ফুটবলে উপজেলা পর্যায়ে রানার্স আপ, ২০১৫ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবলে ইউনিয়ন ও উপজেলায় চ্যাম্পিয়ন এবং জেলা পর্যায়ে রানার্স আপ, ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা এবং বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ইউনিয়ন পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলে উপজেলা চ্যাম্পিয়ন এবং জেলা পর্যায়ে সেমিফাইনালিস্ট। সেই সাথে ২০১৭ সালের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় এবং সেরা গোলদাতা নির্বাচিত হয়েছিল আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে পুনরায় বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবলে ইউনিয়ন পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে উপজেলায় খেলার যোগ্যতা অর্জন। ২০১৯ সালে আবারো বঙ্গবন্ধু এবংব বঙ্গমাতা ফুটবলে উপজেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে জেলা পর্যায়ে অংশগ্রহণ। জেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা গোল্ডকাপ ফুটবলের সেমিফাইনালে ভালো খেলেও দুর্ভাগ্য বশত হেরে যায়। ছেলেরা প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেয়। শুধু তাই নয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হার শতভাগ। খেলাধুলা, লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে যা সত্যিকার অর্থে প্রশংসার দাবিদার। বিদ্যালয়ের গরিব শিক্ষার্থীদের খাতা, কলমের ব্যবস্থা করার জন্য মাঝে মাঝে ছুটে যাই পরিচিত স্বচ্ছল বন্ধু-বান্ধবদের কাছে। সাথে নিজেও সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করি গরিব শিক্ষার্থীদের মুখে হাসি ফুটাতে। সারাদেশ জুড়ে প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষ নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক আমার বিদ্যারয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী এখন মিড ডে মিলের আওতাভুক্ত। শিক্ষার্থীরা এখন বাড়িতে খাবার খেতে যায় না। বাড়ি থেকে খাবার এনে শিক্ষকদের সাথেই খায়। এতে করে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া রোধ সহ, বিদ্যালয়ের শিখন শেখানো কাজে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বর্তমানে ম্যানেজিং কমিটি, পিটিএ কমিটি, অভিভাবকদের সহায়তার ফলে দক্ষিণ কড়লডেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি উপজেলা ছাড়িয়ে জেলার আনাচে কানাচে পরিচিতি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়া বিদ্যালয়ের পরিচিতিকে আরও বেশি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বৈদেশিক শিক্ষা সফর ও প্রশিক্ষণে ফিলিপাইন ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। ২০১৯ সালে পুনরায় বোয়ালখালী উপজেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছি। কাব কার্যক্রম জোরদারের কারণে উপজেলার কাব লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আইসিটি’র উপর বোয়ালখালীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছি। করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের সাথে কাজ করে নির্বাচিত হয়েছি করোনা যোদ্ধা হিসেবে।বোয়ালখালীর দক্ষিণ কড়লডেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলে যাওয়াই প্রমাণ করে কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং নিজের বিদ্যালয়কে আমার বিদ্যালয মনে করাই পারে সফলতা এনে দিতে। আর এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ নেতৃত্ব। জানি না কতুটুকু সফল হয়েছি। তবে ৮ বছরে পাল্টে দিয়েছি পিছিয়ে পড়া একটা বিদ্যালয়কে।