Loading..

প্রকাশনা

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কেন শিক্ষক হলাম ও কেমন শিক্ষক হওয়া উচিত
কেন শিক্ষক হলাম ও কেমন শিক্ষক হওয়া উচিত ।।আতাউর রহমান।। আমি ছিলাম একজন গ্রামে পড়ুয়া শিক্ষার্থী । আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সেই শিক্ষক আব্দুল হাছিব, কটই স্যার'কে আজও মনে পড়ে- যারা আমার লেখাপড়ার ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান ছিলেন। আমার শিক্ষকরা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ছিলেন না। সেইসব শিক্ষক আমাকে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন। কিন্তু পড়ানোর জন্য কোনো অর্থ নেননি। তাদের একান্ত ইচ্ছা ছিল, পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে স্কুলের মুখ যেন উজ্জ্বল করি। মাস্টার আজাদ বক্ত ছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। রুটিন অনুযায়ী তিনি স্কুল পরিচালনা করতেন। মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন, খুবই আন্তরিক। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি আমাকে খুব বেশি আদর করতেন ও আমার দিকে বেশ লক্ষ্য রাখতেন। আমি ছিলাম দরিদ্র, কিন্তু মেধাবী। সেই হাছিব স্যার তিন মাইল দূরে বিয়ানীবাজার সদরের বৃত্তি পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পথে ছিল ছোট 'লোলা' নদী। নদীর উপর ছিল বাশের লম্বা সাঁকো। আমার সেই প্রিয় শিক্ষক এক হাতে ধরে আমাকে সাঁকো পার করালেন। সাঁকোর পশ্চিম পাড়ে মাচানে বসা 'রহমত'কে জন প্রতি পাড়ি দিতে দশ পয়সা দিতে হয়। সেটিও স্যার দিয়েছিলেন। কেন্দ্রে গিয়ে দেখি আমার স্কেল নেই। স্যার শুনে তৎক্ষণাৎ আমাকে একটি স্কেল কিনে দিলেন। মূলত তাদের হাত ধরেই লেখাপড়ার ট্রেনে উঠা। সেই প্রাইমারি স্কুলের তিন আদর্শ শিক্ষকের দু'জন আজ আর ইহজগতে নেই। খোদা যেন উনিদের আত্মা শান্তিতে রাখেন। হাছিব স্যার এখনও বেচে আছেন। তাদের কথা বেশ মনে পড়ে। হাই স্কুল জীবনেও আমার অনেক আদর্শ শিক্ষকের কাছে পড়ার সুযোগ হয়েছিল, তন্মধ্যে আলী আহমদ হেডমাস্টার, হাবিবুর রহমান বিএসসি স্যার, আপ্তার আলী হেডমাস্টার, মঈনুদ্দীন স্যার, ছাদ উদ্দিন স্যারের কথা বেশ মনে পড়ে। সবাই সিলেটের সন্তান। যারা আমাকে বিনামূল্যে বই দিতেন, যারা আমার পরীক্ষার ফলের ব্যাপারে উদ্বেলিত ছিলেন, যারা আমাকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দিতেন। এ রকম কলেজ জীবনেও অনেক আদর্শ শিক্ষক পেয়েছিলাম। প্রফেসর মাহবুবুর রশীদ চৌধুরী, অধ্যাপক ফজলুল হক, অধ্যাপক বিশ্বনাথ দে, জাকারিয়া স্যার, ড. সফি উদ্দিন আহমদ, প্রশান্ত কুমার স্যারদের কথা আজো মনে পড়ে। তখন নিজেও টিউশনি পড়াতাম। টিউশনির বদৌলতে আমার আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হয়ে উঠেছিল। যা হউক, আমার স্যার'রা ছিলেন কলেজের নামকরা শিক্ষক। তারা ক্লাসরুমে পাঠদানে অতি যত্নবান ছিলেন। একেক জন ছিলেন শিক্ষাংগনের হ্যামিলনের বাশিওলার মত। এরকম অনেক আদর্শ শিক্ষকের কাছে পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য স্নেহমমতা পাওয়ার বিষয়টি তখন গৌণ হয়ে গিয়েছিল। কারণ বয়স বেড়ে গেছে। মন চাইতো কোন শিক্ষক বেশি জানেন সেই শিক্ষকের খোঁজ নিতে। আমি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম গেল শতাব্দীর অষ্টাদশ দশকে। সেই সময়কার শিক্ষক জ্ঞান-গরিমা নিয়ে বিচরণ করতেন। তারা ছিলেন আদর্শের প্রতীক। তাদের অনুসরণ করতাম। ভাল লাগতো তাদের দেখানো পথে চলতে। দেহের গঠনে তারা ছিলেন ভিন্ন রকম। কিন্তু জ্ঞানের বহর এবং বর্ধনের ক্ষেত্রে তারা যেন কেউ কারও থেকে কম ছিলেন না। বর্তমান সময়ে শিক্ষক সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তবে বিখ্যাত শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম। আজিকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাকে অন্য কিছু করার একটা হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু আগেকার দিনে যিনি শিক্ষক ছিলেন তিনি শুধুই শিক্ষক ছিলেন। ক্লাসরুমে যেসব বইয়ের রেফারেন্স দেওয়া হতো অনেক ছাত্র ওই সব বই অনেক বেশি পড়ত। তখনকার সময় ক্লাস-লাইব্রেরিতে ছাত্রদের অধিকাংশ সময় কেটে যেত। রাতের পড়া, টিভি দেখা শেষ হলেই নির্ধারিত সময়ে ঘুমিয়ে যাওয়া ছিল দৈনন্দিন কাজ। তখনকার ছাত্রদের একটা লক্ষ্য ছিল- কৃতকার্যতার আকাঙ্ক্ষা। কখন পাস করে বের হবে, কখন চাকরির জন্য পরীক্ষাটা দেবে। কখন উচ্চ ডিগ্রির লাভের জন্য বিদেশ যাবে। অধিকাংশরাই লক্ষ্য অর্জনে সফল হতো। বড়দের কৃতকার্যের কথা শুনে আমরাও নিজেদের স্বপ্নটাকে উজ্জ্বল করে ভাবতাম। হ্যাঁ স্বপ্ন অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে নিজেও শিক্ষক হয়ে গেলাম। বে-সরকারি স্কুলের শিক্ষক হয়েও সরকারি অর্থায়নে পেশাগত উন্নতি সাধনে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিলাম। তখনই বুঝলাম, প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। এই মহান পেশায় শান দেওয়া হচ্ছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা হোক, মফস্বলে থেকেও সেরা ছাত্রদের শিক্ষক হয়ে গেলাম। সরকার বাহাদুর আমাদের (খলিল চৌধুরী আদর্শ বিদ্যানিকেতন) স্কুলের শিক্ষকদেরকে নগদ এক লক্ষ টাকা মূল্যের প্রেষণা দিলেন। এই পেশাগত দায়িত্ববোধ থেকে আমি প্রাণভরে পড়ানোর চেষ্টা করেছি ও করছি। ছাত্র এবং আমার মধ্যে তেমন দূরত্ব নেই বললেই চলে। শিক্ষক হিসেবে যতটা আদর্শিকতার জ্ঞান মেনে চলা দরকার সেভাবে চলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। গত ২৭ বছরে অনেক শিক্ষার্থী পড়িয়েছি যাদের অনেকে এখন নিজেরা লব্ধ প্রতিষ্ঠিত। চলতে ফিরতে সালাম পাই। আমার ছাত্ররাই এখন আমার সহকর্মী। টিম ওয়ার্ক বেশ ভাল হয়। আবার তাদের কেউ ডাক্তার, কেউ আইনিজীবি, কেউ ব্যবসায়ী, হরেক রকম পেশায় নিয়োজিত তারা। যখন কেউ বলে আমি আপনার ছাত্র ছিলাম তখন মনটা খুশিতে এবং পূর্ণতায় ভরে যায়। অনেকেই রস করে আমাকে বলে যে, স্যার, আপনার কি বয়স বাড়ে না। আপনি এখনো তরুণ যুবকের ভূমিকায়। কি করে সম্ভব! আমি তখন বলি, তোমাদের (শিক্ষার্থীদের) সাথে প্রতারণা করিনি, তাই হয়তো এমন আছি। একটা অভ্যাস আছে, ক্লাসে দেরিতে প্রবেশ করার প্রবণতা আমার নেই। ঠিক ঘণ্টা শুরু হওয়ার আগেই দরজায় গিয়ে হাজির হই। কারণ, অভিজ্ঞতা বলে, শিক্ষকের অবর্তমানে নেতিবাচক প্রবণতা বাসা বাধেঁ। এ সুযোগেই শিক্ষার্থীরা শিখন পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যা ফিরিয়ে আনা শ্রেণী কার্যক্রমে কালক্ষেপনের সামিল। আর শ্রেণীতে পাঠের উদ্দেশ্য বলা আর বোর্ডে লেখা এবং পাঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠদান করি। কখন যে ৪৫ মিনিট শেষ হয়ে যায়। দরজায় এসে অন্য শিক্ষক হাজির। ঐ দিনের জন্য ছাত্রদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীরলয়ে বেরিয়ে পড়ি। কোনো দিন ছাত্রদের মধ্যে পার্থক্যকরণ শিখিনি। কোনো দিন জিজ্ঞেস করিনি কোন ছাত্রের বাপ-মা কি করেন। কারণ, সব শিক্ষার্থী আমার কাছে সমান। আর এখন তো ডিজিটাল। পুরাতন লেকচার পদ্বতিতে শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয় থাকে বিধায় অংশগ্রহনমূলক পদ্বতিতে শিক্ষককে পড়াতে হয়, এখন শিক্ষার্থীরা মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিখে। আর শিক্ষক থাকেন আম্পায়ারের ভূমিকায়। শিক্ষাংগন থেকে বিদায় হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা যখন কোনো চাকরির জন্য অথবা বিদেশ যাওয়ার জন্য আমার কাছে পরামর্শ চাইতে আসে, আমার কর্তব্য ভেবে ছাত্রদের সাহায্য করি। কারন, আমি আমার শিক্ষকদের থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছি। আমারও কর্তব্য ছাত্রদের সাহায্য করা। একটা কথা আমি তাদের বারবার বলি, সেটা হলো- জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের জন্য ভালো ও মানসম্পন্ন বইয়ের দরকার হয়। তাদেরকে বলি, লেখাপড়া করে সৎ হতে, পরিশ্রমী হতে । আজও আমি আমার ছাত্রদেরকে শিখাই- সৎ থেকো ও পরিশ্রম কর। আর সৎ কাজের জন্য সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করো। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার, পদ-পদবি মানুষকে জ্ঞানী করে না, সম্মানীয় করে না। জ্ঞান-সম্মান এগুলো পৃথক ও স্বতন্ত্র বিষয়। পদের অধিকারী হয়ে কেউ যদি অধঃপতনের জীবনযাপন করে তাহলে সে-তো একজন অসফল ব্যক্তি। ওই ধরনের লোকদের কাছ থেকে শেখার কিছুই থাকে না। আজকে সন্তানদের শিক্ষা দিতে গিয়ে অভিভাবকরা বড়ই বেকায়দায় পড়েছেন। অনেক ধরনের শিক্ষা। ব্যক্তিখাতে শিক্ষার শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। সেই সঙ্গে শিক্ষায় ঢুকে পড়েছে বাণিজ্যিক অর্থের লেনদেন। এখন শিক্ষকরাও যেন কেমন হয়ে গেছেন। সব কিছু ত্যাগ করে তারাও অর্থের পেছনে ছুটে চলেছেন। তারা শিক্ষাকে পণ্য ভেবে বিক্রিতে নিজেদের নিয়োগ করেছেন। নিজেদের ছাত্রদের অর্থের বিনিময়ে নিজেরা প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। অভিভাবকরা বলেন, শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়ালে অমুক শিক্ষক কম নম্বর দেন। কোনো কোনো শিক্ষক নাকি ক্লাসে বকাঝকা দিয়ে ছাত্রকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করে। হায়রে শিক্ষক! তোমার এমন অধঃপতন তো হওয়ার কথা ছিল না। তুমি তো ক্লাসরুমে এসব ছাত্রদেরকে একই পাঠদান করার কথা। আর আজকে তুমি সেই পাঠদান ছেড়ে নিজেই শিক্ষা বিক্রির ব্যবসা পেতে বসেছ। অথচ ক্লাসরুমে মনোযোগের সঙ্গে শিক্ষা দেওয়ার জন্য জনগণের অর্থে তোমাকে বেতন দেওয়া হয়। সেদিকে খেয়াল নেই। শিক্ষকদের অধঃপতন শুধু সাধারন স্কুল-কলেজে নয়।। মেডিকেল কলেজগুলোতে অধ্যাপক পদবিটা অর্জন করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন এক ধরনের ডাক্তার-শিক্ষক। কারণ অধ্যাপক হলে বিকালে রোগী বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু কথা হলো সকালের কর্মস্থলের রোগীরা অধ্যাপক সাহেবের মনোযোগ তেমন পায় না। সরকারি মেডিকেল, স্কুল-কলেজের চাকুরী মূল্য হলো: এসব পদবি অর্জন করা। এসব পদবি অর্জন করতে পারলে চড়া দামে ওইগুলোকে বিক্রয় করা যায়। যতই দিন যাচ্ছে ততই রাজনীতি-দলবাজির ডামাঢোলে টক জাতীয় ঢেফলগুলো আপেলের রং ধরতে শুরু করেছে। সর্বত্র কেন জানি এখন নেতিবাচক প্রভাব বিরাজমান। আমাদেরকে ইতিবাচক দৃষ্টি গ্রহন করতে হবে- নৈতিকতার স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, কল্যাণের স্বার্থে। বর্তমানের অবস্থা অতীত সময়ে যদি থাকত, তবে আমার মতো না-লায়েক বান্দার লেখাপড়া করার সূযোগ হত কি-না, কে জানে? আমাদের সময়ের সেই আদর্শ শিক্ষকরা আদর্শ থাকতেন কিনা জানি না। তবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, আমাদের সময়ের শিক্ষকরা কোনক্রমেই বাণিজ্যিক ছিলেন না। লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট। সভাপতি- বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব, সিলেট।

আরো দেখুন