সহকারী শিক্ষক
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০৯:৫৪ পূর্বাহ্ণ
ক্ষমতা vs সমাজিকতা
রীতিমতো থতমত অবস্থায় পড়ে গেলেন স্কুলের
প্রধান শিক্ষক। মাত্র অফিসের কাজ নিয়ে বসতেই একদল লোক এসে ঢুকে পড়ল।দলের নেত্বত
দিচ্ছেন এলাকার খুবই পরিচিত নামী একজন লোক।সাথেই দেখা গেলো স্কুলের কমিটিরও কয়েকজন
আছে।“ ডাকেন ওই শিক্ষককে , নতুন আসছে নাকি স্কুলে ?” প্রায় চিৎকার করেই বলতে
লাগলেন সেই পরিচিত লোকটি।প্রধান শিক্ষক অবস্থা সামলানোর জন্য বললেন, আরে ভাই আপনি?
বসেন, কি হয়েছে?, এ্যাই কে আছিস চা দিয়ে যা।‘’ বছরের প্রায় প্রতিদিন এমন বিভিন্ন
সমস্যা নিয়ে মানুষ জন আসে ,কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম মানুষ আছে যাদের উপস্থিতি অন্য
ইঙ্গিত দেয়। নিজের সাথে বলা কথায় ছেদ পড়ল কমিটির একজন সদস্য বলে ওঠলেন, “ চা খেতে
আসিনি মাস্টার। কি করেন আপনারা স্কুলে বাচ্চাদের সাথে? ,বিনয়ের সাথে প্রধান শিক্ষক
জানতে চাইলেন,’কী হয়েছে ভাই?সব না বললে আমি বুঝবো কিভাবে?’দল থেকে একজন গলা ছেড়ে
বলল,”ভাইয়ের একটা মাত্র মেয়ে আপনার স্কুলে পড়ে।আপনার স্কুলের কোন মাস্টর নাকি সে
পড়া শিখেনি বলে দাড় করে রাখছে? সে কি ভাই রে চিনে না? নতুন নাকি? পড়া শিখেনি বলে
কি আপনারা এইভাবে বাচ্চাদের সাথে অত্যাচার করবেন?ডাকেন ওই মাস্টর কে।’ পরিস্থিতি
সামলানর জন্য প্রধান শিক্ষক সেই স্যার কে ডাকপাঠালেন।এর মাঝেই শুরু হয়ে গেল আশেপাশের কোন এলাকায়
কিভাবে পড়ানো হচ্ছে, কিভাবে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের অত্যাচার করছেন।কেউ কেউ তো
আবার বলছেন পেপারে লেখা গেলে কি হবে একবার ভেবে দেখেন।ততক্ষনে সেই শিক্ষকও রুমে
হাজির হয়ে গেলেন।এতো সময় পর সেই দামী
লোকটি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “ শোনেন স্যার, আমার মেয়ে আপনার স্কুলে পড়ে। সে না হয়
পড়া শিখে আসেনি ,তাই বলে কি আপনি তাকে ক্লাসে দাড় করিয়ে কথা শুনাবেন? আপনাদের কাজই
তো পড়া শিখানো।মেয়েটা আমার বাসায় গিয়ে অনেক কান্না করছে।আজকে স্কুলে আসতে
চাইনি।মেয়ের মা তো তখনই স্কুলে আসতে চাইছিল, আমি আসতে দেইনি।একটা মাত্র মেয়ে আমার রাজকন্যার মতো রাখছি।আপনারা যদি
এইভাবে তাদের সাথে অত্যাচার করেন তাহলে শিক্ষার্থীরা কই যাবে?শোনেন, শিক্ষক মানুষের এতো রাগ ভালো না।বুঝলেন?’রুমে আসার আগেই
প্রবীণ শিক্ষকরা নবীন শিক্ষকে বলেদিয়েছিলেন, কিছু না বলতে ।কারণ তেমন কিছুই না ,
এই লোককে কিছু বলে লাভ নাই। তাই সেই শিক্ষক নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।প্রধান শিক্ষক তখন
কথায় তাল মিলিয়ে বললেন,”ভাই এই বিষয়ের জন্য কি আবার এতো লোকজন নিয়ে স্কুলে আসতে
হয়? এরপর থেকে আমরা সবাই খেয়াল রাখবো।ভাই, চা খান , ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
রাজকন্যা নামে মাত্র জেএসএসি পাস
করল।ক্লাস নাইনের পরীক্ষায় কয়েক বিষয়ে খারাপ করেছিল, কিন্তু সেই ঘাড় বয়ে ঝামেলা কে
নেবে? তাই সবার সম্মতি ক্রমে তাকে পাস দেখিয়ে দশম শ্রেণিতে পাশ দেয়া হলো।দশম
শ্রেণির টেষ্ট পরীক্ষার আগেই বিয়ের পিড়ীতে বসল সেই রাজকন্যা।বেশ ধুমধাম করেই এই
বাল্যবিবাহ হলো বিলেত ফিরত এক ছেলের সাথে।বিয়ের পর ছেলের সাথে বিদেশ চলে যাবে তাই
পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু বিয়ের ছয়মাস পর চিত্র বদলাতে লাগল।মাতাল জামাই এর হাতে
মার খাওয়া তার জন্য স্বাভাবিক জীবন যাত্রা হয়ে গেলো।কথা ছিল রাজকন্যা রাণী হবে,কিন্তু
হয়ে গেলো দাসী।গায়ে মারের দাগ নিয়ে বাপের
বাড়ি এল মেয়ে । মাকে কান্না করে সব কথা বলে ,যাইতে চাইল না আর জামাই বাড়ি। চোখের
জল মুছে দিয়ে রাজকন্যার মা বললেন,”আম্মা শোন বিয়ের পর জামাইয়ের বাড়ি হয় মেয়ের আসল
ঠিকানা।মেয়েদের এসব একটু আরেকটু মানিয়ে নিতে হয়। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।“
মা-র কথা তার মন মতো হলো না, সে তার
বাবার কাছে গেলো।বাবা কে গিয়েও সব কথা বলে জানিয়ে দিল সে আর জামাইয়ের বাড়ি যাবে
না।তার বাবা তখন তার মা কে ডেকে পাঠালেন এবং জানিয়ে দিলেন”তোমার মেয়ে কে
বুঝাও,শিখালে কি এতোদিন? সমাজে আমার সম্মান দেখি নষ্ট করে দিবে। সারাদিন বাসায়
শুধু অন্ন ধ্বংস করছো,একটা মাত্র মেয়ে কে মানুষ করতে পারলে না।জামাই আমাকে কল দিয়ে
সব বলেছে ,তোমার মেয়ে নাকি শ্বাশুড়ির কথা শুনে না।মেয়ে কে ভালো করে বুঝিয়ে পাঠাও।
জামাইয়ের বাড়িথেকে ফিরে এলে সমাজে তার কোন দাম থাকবে না। আমি আর সমাজে কথা বলতে
পারবো না।জামাই আসছে তাকে নিতে, রেডি থাকতে বল।“রাজকন্যার আর বুঝতে বাকি রইল না , এখন তার কথার
কোন দাম নেই।বাবা চলে যাবার পর মা অনেক কথা বলে যাচ্ছেন, মা-র কথা গুলো ঝাপিয়ে তার
মনে পড়ল ,শিক্ষকের ধমকটা অত্যাচার ছিল কিন্তু জামাই বা জামাই বাড়ির লোকেদের করা
আচরণ অত্যাচার এর মাঝে পরে না।তার বাবা স্কুলেযাবার পর থেকে তাকে আর কোনদিন কোন
শিক্ষক পড়া জিগাসা করেনি।সেই শিক্ষক তো তার দিকে তাকতোই না,বিষয় টা তাকে খুব আনন্দ
দিতো, মনে হতো স্যারের উচিত শিক্ষা হয়েছে।বান্ধবীদের সাথে খুব গর্ব করে চলা-ফেরা
করত।আর আজ,চোখের জল মুছে কাজল দিতে হবে।গালে থাপ্পড় এর দাগ মেইকয়আপ দিয়ে ডাকতে হয়।ঠোটের কোনায় কাটা
রক্ত লিপস্টিক দিয়ে মুছে দিচ্ছি। বিজ্ঞাপন গুলো কেন দেখায় মেয়েরা নিজেদের সুন্দর
করার জন্য সাজছে।মেকইআপ তো সমাজের কালিমাগুলো ও ঢেকে দিচ্ছে।এইজন্যই তো পণ্যগুলোর
এতো দাম।বাবা-মা মনে হয় আজ অত্যাচার শব্দটা ভুলে গেছেন।কিংবা কোনটা অত্যাচার আর
কোনটা শাসন পার্থক্য জানেন না।