সিনিয়র শিক্ষক
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১১:৫১ অপরাহ্ণ
শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশে করণীয়
দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে
শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো খুবই জরুরি। তবে দেশের
বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে
কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশ ও জাতি গভীর সামাজিক
সংকটের মুখে পড়তে পারে। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজের করণীয় কী এ ব্যাপারে মূল্যবান
মতামত দিয়েছেন দেশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা।
“ধর্মীয়
জ্ঞান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই” নুরুল ইসলাম নাহিদ , সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী
শিক্ষার্থীদের মধ্যে
নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি গড়ে তুলতে পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ
পরিবারেই এসবের বীজ প্রোথিত হয়। এছাড়া সামাজিক পরিবেশ দেখে শিশুরা অনেক কিছু শেখে।
এজন্য সমাজকে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষ
হিসেবে গড়ে তোলেন। সামাজিক কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতিও শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে। তাই প্রাথমিক
থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সকল স্তরে নিয়মিত দেশের কৃষ্টি-কালচারবিষয়ক
অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও
সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি শক্ত ভিত গড়ে উঠবে। ফলে তারা বিপথগামী হওয়া
থেকে বিরত থাকবে। সেইসঙ্গে তাদের মননশীলতার বিকাশ ঘটবে। এছাড়া মূল্যবোধ সৃষ্টিতে
ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। ধর্মের প্রকৃত পাঠই শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও
মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যাখা দিয়ে
কেউ যাতে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
“শুধু
শিক্ষা নয়, চাই সুশিক্ষা” কর্নেল নূরন্ নবী (অব.) সাবেক প্রতিষ্ঠাতা
অধ্যক্ষ, মাইলস্টোন
কলেজ এবং রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ।
‘যদি তুমি এক বছরের
পরিকল্পনা মতো ফল পেতে চাও তবে শস্য রোপণ কর, যদি দশকের
পরিকল্পনায় ফল পেতে চাও তবে বৃক্ষরোপণ কর আর যদি সারা জীবনের জন্য পরিকল্পনা করে
ফল পেতে চাও তবে মানুষের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা কর।’ এটি দার্শনিক কুয়ানত্সুর
মত। বস্তুত এই সুশিক্ষা শব্দটির মধ্যেই সব প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তর সন্নিবেশিত
থাকছে। আমরা নৈতিক শিক্ষার কথাই বলি বা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার কথাই বলি
সবকিছুর একটা সহজ মেলবন্ধন হবে সুশিক্ষা। বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
নৈতিক এবং মানবিক শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরেকবার ভাবতে বাধ্য করেছে। শুধু
শিক্ষা নয়, চাই সুশিক্ষা। যে শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর
নৈতিক মানদণ্ডকে উন্নত করার পাশাপাশি তার ভিতরকার মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখবে।
শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবক
সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে করে ক্লাসের শিক্ষা শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ
ও সৃজনশীল চিন্তার প্রসার ঘটাতে পারে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বা স্বাভাবিক
চিন্তা-চেতনা বাধাগ্রস্ত হয় এমন কিছু করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, জীবনের শুরুতে চিন্তা-চেতনার স্বাভাবিক ধারা বাধাগ্রস্ত হলে তা থেকে
বৈপরীত্য জন্ম নেয়। এ ধরনের পন্থা কখনো আদর্শিক নয় বরং সাংঘর্ষিক হয়। সুতরাং
সন্তানের কোমল চিন্তা-চেতনাকে লালন করতে হবে এবং এর বিকাশে আমাদের ভূমিকা হবে
সার্বক্ষণিক সহায়ক।
প্রতিটি মানুষের
জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। যেখানে বাবা, মা, পরিবার-পরিজনের প্রত্যেক সদস্যই শিক্ষকের
ভূমিকা পালন করে। জীবনযাপনের দায়ে আমাদের সকাল শুরু হয় ব্যস্ততা দিয়ে আর রাত আসে
ক্লান্তি নিয়ে তবুও সবকিছুর ডামাডোলে আপনার সন্তানকে কখনোই আড়াল করতে যাবেন না।
অনেক সময় না হোক, অল্প সময় নিয়ে হলেও প্রত্যেকদিন
সন্তানের খোঁজখবর রাখতে হবে অন্যথায় আপনার সব কষ্টার্জিত সফলতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত
হবে।
অভিভাবক হিসেবে
মাঝেমধ্যে আন্তরিকতা নিয়ে সন্তানের পাশে বসুন। শাসন, হাপিত্যেশ,
চাওয়া পাওয়া বা অভাব অভিযোগ নয় বরং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলাপ
করুন। সে কী চায়, কীভাবে চায়, কেন
চায় তা জানার পাশাপাশি এর ধরন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করুন। ব্যাপক অর্থে
সন্তানকে জানুন এবং তাকে জানান— মানুষের মতো মানুষ হওয়ার কথা, মূল্যবোধের কথা, ইতিহাস ঐতিহ্য, শিল্পিত সংস্কৃতিবোধ এবং আমদের গর্ব মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা।
আলোয় ভরা ভবিষ্যৎ মানে আমাদের সন্তান। সমৃদ্ধ দেশ, সুন্দর বিশ্ব মানে আমাদের সন্তান। আসুন, সুন্দর
মানবিক জীবন গড়তে আমরা সন্তানদের পাশে ছিলাম, আছি এবং
থাকব।
“শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর”
মুহম্মদ
আবুল কালাম আজাদ
চেয়ারম্যান, রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড
দেশের
শিক্ষাব্যবস্থায় পরিমাণগত শিক্ষার লক্ষ্য পূর্ণ হলেও ঘাটতি রয়েছে গুণগত শিক্ষায়।
কোমলমতি শিশুদের মননে শৈশব থেকেই জাগ্রত করতে হবে নৈতিকতাবোধ। এই শিক্ষা পরিবার
থেকে শুরু হবে আর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিবেন শিক্ষকরা। পরিবারের সবাইকে ছেলেমেয়েদের
বেড়ে উঠার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আর এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন মা।
শিশুরা যখন বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করবে তখন থেকে তারা পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকদের
তত্ত্বাবধানে চলে আসবে। শিক্ষকরা তাদের অভিভাবক হিসেবে সততা, দায়িত্ববোধ, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা শিক্ষা দিবেন। তাদের শেখাতে হবে সততাই সর্বোত্কৃষ্ট পন্থা,
গুরুজনে কর নতি। বড়দের সম্মান করা অথবা ছোটদের স্নেহ করা এই
মানবীয় দিকগুলো স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে তাদের
পাঠ্যক্রমে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের শুধু
পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত করলে এই সমাজ, মানুষ, পৃথিবী নিয়ে তাদের কোনো সম্যক ধারণা থাকবে না। তাই তাদেরকে পাঠ্যবইয়ের
বাইরে গল্পের বই, কবিতা, উপন্যাসের
সঙ্গে পরিচিত করাতে হবে। শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বড় দায়িত্ব
শিক্ষকদের কাঁধে। কারণ তারা মানুষ গড়ার কারিগর। তবে এই প্রজন্মের কিছু শিক্ষকের
মধ্যে দুর্নীতি, অসততা ঢুকে গেছে। কিন্তু তাই বলে পুরো
শিক্ষক সমাজকে কালিমালেপন করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ভালো-মন্দ
ব্যবহার এবং প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করে দিকনির্দেশনা দিতে হবে শিক্ষকদের। সর্বোপরি,
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে হবে শিক্ষার্থীদের মানসে। আর
এটা কারও একার নয়, বরং সবার দায়িত্ব। সরকার, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পরিবার এবং সমাজের মানুষকে
একত্রিত হয়ে সমকালীন বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা
শিক্ষকদের যেভাবে অনুসরণ করে এইভাবে আর ও কাউকে অনুসরন করে না। শিক্ষার্থীদের কাছে
শিক্ষকরা মডেল। শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা বৃদ্ধিতে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকল্প
নাই। তাই আমরা শিক্ষার্থীদেরকে শ্রেণিকক্ষে পাঠ দানের
পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য তাদের অনুপ্ররণা দিব, ইনশাআল্লাহ।
তথ্য সংগ্রহ ও ভাবনায়ঃ
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
(সুমন)
সিনিয়র শিক্ষক ( গণিত)
আহমেদ বাওয়ানী একাডেমী
স্কুল এন্ড কলেজ
মোবাইলঃ ০১৯১৬১৫৯৯২২