Loading..

খবর-দার

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১০:০৪ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষকতা থেকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম

   

শিক্ষকতা থেকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম


 রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধ্যয়ন শেষে শিক্ষকতা শুরু করেন সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে পুরান ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। এলএলবি পাসের পর আইন পেশায়ও যুক্ত হন। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি সরকারি ঘোষণার পর তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। এরপর আইনজীবী হিসেবে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। রোববার (২৭ সেপ্টেম্বর) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদেই ছিলেন। 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৭১ বছর বয়সে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) রোব্বার সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন ( ইন্নাল্লিাহে...রাজেউন) তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। 

শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, শিক্ষাখাতের নানা আইনী জটিলতা নিরসনে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়।  মাহবুবে আলমের ছেলে সুমন মাহবুব দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে শিশির কনা এবং জামাতা শেখ রেজাউল হক সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী। 

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মৌছামন্দ্রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মাহবুবে আলম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে লোক প্রশাসনে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন তিনি। ছাত্র জীবনে বাম আন্দোলনে যুক্ত মাহবুবে আলম পরে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। 

তিনি ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে সংবিধান এবং সংসদীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইসিপিএস) থেকে সাংবিধানিক আইন এবং সংসদীয় প্রতিষ্ঠান এবং পদ্ধতিতে দুটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আপিল বিভাগের আইনজীবী নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৫-২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯৩-১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশে জরুরি অবস্থা জারির আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন মাহবুবে আলম।

সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই সরকার আমলে শেখ হাসিনা গ্রেফতার হওয়ার পর শীর্ষ আইনজীবীদের অনেকে পিছুটান দিলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাহবুবে আলম। দৃশ্যত সে কারণেই তার উপর আস্থাবান ছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান মাহবুবে আলম। তার পর থেকে টানা ১১ বছর তিনি এ দায়িত্বে বহাল ছিলেন।

সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মাহবুবে আলম। তবে তাকে প্রার্থী না করে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বই চালিয়ে যেতে বলা হয়।

মাহবুবে আলম ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের নয়াদিল্লির ‘ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ’ থেকে সাংবিধানিক আইন ও সংসদীয় প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন।

রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী মাহবুবে আলমের স্ত্রী বিনতা মাহবুব একজন চিত্রশিল্পী। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে সুমন মাহবুব দীর্ঘ দিন সাংবাদিকতায় ছিলেন, মেয়ে শিশির কনা ও জামাতাও আইন পেশায় রয়েছেন। 

তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের মৃত্যুতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।

শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, মাহবুবে আলম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির যোদ্ধা। 

শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি একজন প্রথিতযশা আইনজীবী হিসেবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইনি বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ভূমিকা রেখেছেন এবং সবসময় ন্যায়নিষ্ঠ থেকে আইনপেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যা অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।

শোকবার্তায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মাহবুবে আলম। এছাড়া সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলা পরিচালনাও করেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মামলায়ও যুক্ত ছিলেন মাহবুবে আলম।

মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি। দৈনিক শিক্ষায় পাঠানো শোকবার্তায় তিনি বলেন, দেশের আইন অঙ্গনে মাহবুবে আলমের অবদান জাতি সবসময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। একজন প্রথিতযশা আইনজীবী হিসেবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অনেক আইনি বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জাতীয় ভূমিকা রেখেছেন মাহবুবে আলম। শিক্ষাখাতের বিভিন্ন  আইনি জটিলতা নিরসনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। দৈনিক শিক্ষাডটকমকে পাঠানো এক শোক বার্তায় উপাচার্য বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, সিন্ডিকেট সদস্য ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম ছিলেন একজন খ্যাতিম্যান আইনজ্ঞ ও শিষ্টাচারবোধ সম্পন্ন বিনম্র চরিত্রের প্রকৃত ভদ্রলোক। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এই বিজ্ঞ মানুষের মৃত্যুতে জাতি শুধু একজন বিশিষ্ট আইনবিদকে হারায়নি বরং একজন ভালমানুষকে হারালো। দেশে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তাঁর  মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ। এক শোকবার্তায় উপাচার্য বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দীর্ঘ সময় সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এই প্রয়াণ আমাদেরকে শোকে আচ্ছাদিত করেছে। আইনাজ্ঞনের পথিকৃত মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। সৎ এবং নির্লোভ মানুষ হিসেবে সারাজীবন তাঁকে আমরা মনে রাখবো। আইন পেশায় তাঁর বর্ণাঢ্য এই জীবনে তিনি অনেক মানুষকে আইনী সেবা প্রদান করেছেন। তাঁর চলে যাওযার শূন্যতা পূরণ হবার নয়।

দৈনিক শিক্ষাডটকমে পাঠানো এক শোকবার্তায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য  ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী একজন আইনজীবী। বিভিন্ন আইন ও প্রশাসনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলো ছিল তাঁর গভীর দখলে। তাঁর বিচক্ষণতার জন্য তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতো একজন বিশিষ্ট আইনজীবীর মৃত্যুতে সত্যিকার অর্থে ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন অভিভাবককে হারলাম। আর অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হলো তা পূরণ হওয়ার নয়। 

তাঁর মৃত্যুতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। দৈনিক শিক্ষাডটকমে পাঠানো এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দেশের আইন অঙ্গনে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তাঁর আইনি মেধা ও প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার ফলে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইনি বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ভূমিকা রেখেছেন। দেশের আইন অঙ্গনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রথিতযশা আইনজীবী মাহবুবে আলমের অবদান অনুসরণীয় হয়ে থাকবে এবং জাতি সবসময় তাঁকে শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করবে।