Loading..

ম্যাগাজিন

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০১:২৭ অপরাহ্ণ

কৃষ্ণ গহ্বর ও তার রহ্যস ।

গত ১০ এপ্রিল ২০১৭ ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা হলো। অকল্পনীয় ব্যাপার। মহামারি একটা কাণ্ড। জগতের এই অপার বিস্ময়কে উপলব্ধি করা, চাক্ষুষ দেখা, বোধ সম্পন্ন সত্তার ব্যাপ্তিকে অনেক ঊর্ধ্বে প্রসারিত করে। এই মেসিয়ের-৮৭ নক্ষত্রপুঞ্জের ব্ল্যাক হোলের ছবি সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা যাক

১. এটাকে ব্ল্যাক হোলের ছবি বলা হলেও, তা আসলে ব্ল্যাক হোলের কিনারার ছবি (Edge of Black hole)মধ্যে কালো বৃত্তের মতো জায়গাটিই ব্ল্যাক হোল।

২. ছবিটি সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগের। যে আলো (তরঙ্গ) থেকে এই ছবিটি চিত্রিত করা হয়েছে, তা সেই ব্ল্যাক হোলের আশপাশ থেকে (ইভেন্ট হরাইজন) সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে রওনা হয়েছিল। হালনাগাদ তথ্য জানার কোনো উপায় বর্তমান বিজ্ঞানের সূত্রে জানা নেই।

৩. এখনকার টেলিস্কোপ চোঙের মধ্যে লেন্স বসিয়ে করা হয় না। বড় বড় ডিশ আকাশের দিকে তাক করে রাখা হয়। অনেকটা ডিশ অ্যানটেনার মতোই, তবে অতিকায় এবং লাখো গুণ অগ্রসর।

৪. সহজেই অনুমান করা যায়, টেলিস্কোপ যত বড় হবে, তত দূরের জ্যোতিষ্ক পরিষ্কারভাবে ধরা পড়বে। এমন ঢাউস একটি টেলিস্কোপ বসানো হয়েছে চীনে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপ, তার নাম ফাস্ট। ব্যাস ৫০০ মিটার। এটি গুইঝু রাজ্যের একটি পাহাড়ের পাদদেশে করা হয়েছে। ফাস্ট টেলিস্কোপ বসাতে গিয়ে সেই প্রত্যন্ত গ্রামের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় এক হাজার মানুষকে স্থানান্তর করতে হয়।

কিন্তু, বিজ্ঞানীরা ভাবলেন আরও অনেক বড় টেলিস্কোপ কীভাবে বানানো যায়? সবচেয়ে বড় একটা টেলিস্কোপ কত বড় হতে পারে? পুরো পৃথিবীটার সমান? হ্যাঁ, সেই অসাধ্যই তাঁরা বুদ্ধি দিয়ে সাধন করেছেন। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেকগুলো রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হলো। আমেরিকা, মেক্সিকো, চিলি থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের আটটি অতিকায় রেডিও টেলিস্কোপ সমন্বয় করে বানানো ইভেন্ট হরাইজননামের এই আপাত সমন্বিত টেলিস্কোপ। গোটা পৃথিবীর সমান ব্যসের একটা টেলিস্কোপ বানালে যা হতো, এই আপাত সমন্বিত টেলিস্কোপ কার্যকারিতার দিক থেকে ঠিক তার সমান।

৫. ইভেন্ট হরাইজনকে কাজ করতে হলে এর আটটি টেলিস্কোপ যে যে জায়গায়, সে জায়গায় একই সময়ে আবহাওয়া ভালো থাকতে হবে। যেমন মেঘমুক্ত আকাশ ইত্যাদি। অভাবনীয় ভাবে এই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে। পর পর ছয় দিন এই সব জায়গায় আবহাওয়া ভালো ছিল। সেই সময়ের ডেটা নিয়েই সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে আজকের এই ছবি বিজ্ঞানীরা বের করেছেন।

কৃষ্ণ গহ্বর

 

 ৬. এই ডেটা থেকে কীভাবে ব্ল্যাক হোলের ছবিটি তৈরি করা যাবে, সেই দুরূহ কাজটি করেছেন ২৯ বছর বয়সী কম্পিউটার বিজ্ঞানী কেটি বোম্যান। তিনি তিন বছর পরিশ্রম করে এই অ্যালগরিদমটি বের করেছেন। সেই অ্যালগরিদমের সাহায্যেই আটটি রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে একযোগে পাওয়া ডেটাকে মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্য ছবিতে পরিণত করা হয়। যে ছবিটি পৃথিবীতে সাড়া জাগিয়েছে।

৭. একটি ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরে ঢুকলে যেকোনো বস্তু, ধুলা-বালি, মানুষ-পশু-পাখি, গ্রহ-নক্ষত্র সব চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। সেখানে কোনো ঘটনা ঘটে না। অণু পরমাণুও সামান্যতম নড়াচড়া করে না। সেখানে সময় স্থির হয়ে আছে। সেখানে একটা জিনিসই আছে, বিস্ময়কর ভর, আর আছে কল্পনার তীব্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, যা এত তীব্র যে কল্পনারও অসাধ্য। এমনকি আলো বা অন্য কোনো তরঙ্গও সেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করে সেখান থেকে বের হতে পারবে না। কোটি-কোটি বছরেও না। সূত্রমতেই অসম্ভব। সেই সূত্রটি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আলবার্ট আইনস্টাইন দিয়েছিলেন।

তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে তিনি দেখিয়েছেন মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে স্থান বাঁকা হয়ে যায়। স্থান বাঁকা হয়ে যাওয়া মানে কী, সেটা সেই সময়ে আইনস্টাইন এবং হাতে গোনা কয়েকজন বিজ্ঞানী ছাড়া অন্যদের কল্পনাতেও কুলাতো না। স্থান বাঁকা হয়ে গেলে শুধু বস্তু নয়, আলোর গতিপথও বাঁকা হয়ে যাবে। সেই মাধ্যাকর্ষণ ভীষণ রকমের বেশি হয়ে গেলে আলোর গতিপথ বাঁকা হতে হতে সে আসলে উৎপত্তি স্থলেই আটকা পড়ে যাবে। বের হতে পারবে না।

৮. আলো কথাটির একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। আলোর বৈজ্ঞানিক নাম হলো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। বিদ্যুৎ এবং চুম্বক তরঙ্গ তৈরি করে শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে ধাবিত হয়। এদের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিভিন্ন হতে পারে। মাত্র অল্প কিছু তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো আমরা দেখতে পাই। দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা তাদের রং হিসেবে দেখি, এক দৈর্ঘ্যকে দেখি নীল, আরেক দৈর্ঘ্যকে লাল। অনেক দৈর্ঘ্যকে আমরা দেখতেই পাই না। যেমন বেতার তরঙ্গ, রঞ্জন রশ্মি, যা দিয়ে এক্স-রে করে শরীরের সব দেখতে পাওয়া যায়। অথচ আমরা খালি চোখে শরীরের ভেতরের কিছুই দেখতে পাই না। যেহেতু রঞ্জন রশ্মি আমাদের চোখে ধরা পড়ে না।

আলোর কোনো ভর থাকার কথা নয়। কারণ আলো একটা তরঙ্গ। এ কারণেই আলোর সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। নিউটন মাধ্যাকর্ষণের যে সূত্র দিয়ে গেছেন, সেখানে কোনো কিছুর ভর থাকলেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করবে। আইনস্টাইন দেখালেন, মাধ্যাকর্ষণ মানে স্থানের বাঁকা হয়ে যাওয়া। তাহলে শুধু বস্তু নয়, আলোকেও সেই বাঁকটার মধ্যে অবশ্যম্ভাবী পড়তে হবে। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব তাই বলে।

আজ ১০০ বছরেরও বেশি সময় পরে, তা আবারও তথ্য/উপাত্তের মাধ্যমে সত্য বলে প্রমাণিত হলো। আলো পর্যন্ত বের হয় না বলে মহাজগতের এই অসম্ভব মাধ্যাকর্ষণের জায়গাগুলো ঘোর কালো। তাই এদের নাম ব্ল্যাক হোল, বাংলায় কৃষ্ণ গহ্বর। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এই এপ্রিলের ১০ তারিখে বিজ্ঞানীরা সাধারণের জন্য কৃষ্ণ গহ্বরকে চাক্ষুষ দেখালেন। এমন যে একটা ছবি তুলে দেখানো যাবে, সেটা হয়তো স্বয়ং আইনস্টাইন কখনো কল্পনা করতে পারেননি।

নিবেদক

মোঃআসলাম আলী

প্রভাষক ও বিভগীয় প্রধান

নন্দনগাছি ডিগ্রী কলেজ ,চারঘাট,রাজশাহী

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি