Loading..

প্রকাশনা

০৪ জানুয়ারি, ২০১৫ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: শিক্ষকদের অসন্তোষ, ছুটিতে ব্যাহত শিক্ষা কার্যক্রম
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ; তাঁদের নানা দাবি-দাওয়া। সেসবের জেরে প্রায়ই অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অসন্তোষের কারণে এখনো প্রায় অচলাবস্থায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রশাসনিক বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের এই অসন্তোষের ফলে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একদিকে শিক্ষক অসন্তোষ, অন্যদিকে শিক্ষকদের শিক্ষাছুটি- এ দুইয়ে ব্যাহত হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। ইউজিসির ৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ২০১৩ সালে ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকার কথা ১১ হাজার ৩২৩ জন। তবে কর্মরত ছিলেন ৯ হাজার চারজন শিক্ষক। এক হাজার ৬৫৭ জন শিক্ষক বছরজুড়েই শিক্ষাছুটিতে ছিলেন। এ ছাড়া প্রেষণে থাকা ১৪০ জন, অবৈতনিক ছুটিতে ৮৮ জন, অননুমোদিতভাবে ১৫ জন ও চুক্তি ভিত্তিতে ৪১৯ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। হিসাব করলে দেখা যায়, মোট শিক্ষকের ২০.৫০ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে ছিলেন বা অনুপস্থিত ছিলেন (অননুমোদিত ছুটিতে বা প্রেষণে)। উপস্থিত ছিলেন ৭৯.৫০ শতাংশ শিক্ষক। জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বা কেন্দ্রের ১১ হাজার ৫০৫ জন শিক্ষকের মধ্যে কর্তব্যরত ছিলেন ৮০ শতাংশ শিক্ষক। ইউজিসি প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এবার ২০১৩ সালের তথ্য নিয়ে ৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে। গত রবিবার রাষ্ট্রপতির কাছে সাক্ষাতের সময় চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ইউজিসি। রাষ্ট্রপতি সময় দিলে প্রতিবেদনটি তাঁর কাছে হস্তান্তর করা হবে। তাঁর অনুমোদনের পর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। ইউজিসি প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ করেছে। অনেক শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না; অনেক সময় শিক্ষার্থীদের নোটিশ না দিয়েই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকেন। ব্যবহারিক ক্লাসেও পর্যাপ্ত সময় দেন না তাঁরা। একজন শিক্ষককে প্রতি সপ্তাহে কত ঘণ্টা ক্লাস নিতে হবে- এ ব্যাপারে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়ম আছে, তবে যথাযথভাবে মানা হয় না। একজন শিক্ষককে কত সময় কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে- এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিধান নেই। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে উত্তরপত্র বিলম্বে মূল্যায়ন করার অভিযোগও রয়েছে প্রতিবেদনে। ফলে নিয়মিত ফলাফল প্রকাশিত হচ্ছে না। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন; কেউ কেউ একাধিক প্রতিষ্ঠানে। তাঁরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। প্রতিবেদনে শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন ও সার্বিক আচরণের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও যথাযথ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে ইউজিসি। বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন চার হাজার ৯৪০ জন। ২০১৩ সালে দুই লাখ শিক্ষার্থী বাড়লেও উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৪। ২০১২ সালে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষকের হার ছিল ৪৭ শতাংশ। ২০১৩ সালে শিক্ষকের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও তাঁদের শতকরা পরিমাণ কমেছে। ২০১৩ সালে পিএইচডিধারী তিন হাজার ৯৭৯ জন, অন্যান্য উচ্চতর ডিগ্রিধারী ৯৭৫ জন এবং উচ্চতর ডিগ্রি ছাড়া ছয় হাজার ৩৬৯ জন শিক্ষক ছিলেন। দেশের সেরা সদ্য স্নাতক শিক্ষার্থীরা পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের জন্য দেশ ত্যাগ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগ ফিরছে না। ফলে তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। দেশে এমফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার উৎকর্ষ ধরে রাখা যাচ্ছে না। উচ্চতর গবেষণার সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় বৃত্তি প্রবর্তন করা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়াতে শিক্ষার্থী বেতন ও আবাসিক হলে সিট ভাড়া বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আনুপাতিক হার অনুকূলে না হলে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ হার সন্তোষজনক নয়। ২০১৩ সালে ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ছিল ২১ লাখ ৬০২ জন; শিক্ষক ছিলেন ১১ হাজার ৩২৩ জন। গড় অনুপাত ১ঃ১৯ হলেও ক্ষেত্রবিশেষে ১ঃ৪ বা ১ঃ৫২। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সবচেয়ে কম, ১ঃ৪। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অনুপাত সর্বোচ্চ, ১ঃ৫২। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ৪৪, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ৩৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ৩৪, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ২৮, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ২৬, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ২৫, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ২৪ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ঃ২২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার ১ঃ১৫। ইউজিসির মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১ঃ১৫ থেকে ১ঃ২০ হওয়া উচিত। ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর তুলনায় ছাত্র বেশি- ৫৭ শতাংশ ছাত্র ও ৪৩ শতাংশ ছাত্রী। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে কলা অনুষদে, ৩৬.৫৩ শতাংশ। এরপর সামাজিক বিজ্ঞানে ২৬.৩০, বিজ্ঞান, কৃষি ও কারিগরিতে ১১.৫৫, বাণিজ্যে ২২.৭৩, আইনে ১.১৭, শিক্ষায় ১.৩১ এবং ডিপ্লোমা বা অন্য কোর্সে ০.৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ইউজিসি বলেছে, উচ্চশিক্ষার মোট শিক্ষার্থীর ৪৮ শতাংশ অধ্যয়ন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে এখান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্নাতকদের গুণমান আশানুরূপ নয়। শিক্ষক নিয়োগ বা বদলিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। প্রায় আড়াই হাজারের মতো কলেজের ব্যাপারে খোঁজ রাখা তাদের পক্ষে দুরূহ। এসব বিবেচনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা যেতে পারে, যেখানে কেবল এমএস ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকবে। কেবল ঢাকা বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের কলেজগুলো এর অধিভুক্ত থাকবে। বিভাগীয় শহরে একটি করে স্বায়ত্তশাসিত স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই বিভাগের কলেজগুলো অধিভুক্ত করা যেতে পারে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ মোহাব্বত খান বলেন, 'শিক্ষকদের ছুটি মঞ্জুর করার দায়িত্ব উপাচার্যের। শিক্ষকরা ছুটিতে গেলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না সেটা ভাবা তাদেরই দায়িত্ব। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে গেলে অনুমতি নিতে হয়। অনেকে অনুমতি না নিলেও সবাই জানে কে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইউজিসি নিয়োগ দেয় না, দেয় সরকার। আমরা বার্ষিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিষয়গুলো সরকার ও জনগণকে জানাতে পারি, সুপারিশ করতে পারি কেবল। তবে উচ্চশিক্ষা কমিশন হলে সব দায়িত্ব আমাদের ওপর এসে পড়বে। তখন আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব। জবাবদিহি করাতে পারব।'

আরো দেখুন