Loading..

প্রকাশনা

০৪ জানুয়ারি, ২০১৫ ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রাথমিক পরীক্ষা থাকা না থাকার যৌক্তিকতা: মাছুম বিল্লাহ
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা কি সবাই শুদ্ধভাবে বা কত শতাংশ শুদ্ধভাবে বাংলায় কথা বলতে পারে? তারা সবাই কি বাংলা বই দেখে পড়তে পারে? ইংরেজি বই দেখে পড়তে পারে? বাংলায় তার বিদ্যালয় বা তার গ্রাম সম্পর্কে একটি প্যারাগ্রাফ নিজ থেকে লিখতে পারে? তারা কি সাধারন হিসেবে নিকেশ করতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কি আমরা কখনও খুঁজে দেখেছি? আমি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা পড়তে দিয়েছিলাম পড়তে পারেনি সে অর্থে কেউই। ইংরেজিও না। তারা পড়তে পারবে কেন? বাংলা বা ইংরেজি বই দেখে পড়তে পারাটা তো পরীক্ষায় ছিলনা, তারা ও নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবে কেন? অথচ তারা সবাই কিন্তু ক্রিকেট খেলা জানে, অনেকেই দেশী বিদেশী ক্রিকেট খেলোয়াড়দের নাম জানে। ক্রিকেট খেলা কিন্তু তাদের পাঠ্য বইয়ে নেই, কাসে পড়ানো হয়না, শিক্ষক এ নিয়ে আলোচনা করেননা, ক্রিকেটের ওপর তাদের কোন পরীক্ষাও হয়না বা হয়নি বা হবেনা। ক্রিকেট খেলা তারা বুঝে, ভাল বুঝে, সময় পেলেই , সুযোগ পেলেই ক্রিকেট খেলায় নেমে পড়ে। কাউকে বলে দিতে হয়না, জোরাজুরি করতে হয়না, ভয় দেখাতে হয়না। বাচচাদের পড়ালেখা হওয়া উচিত ছিল এই ক্রিকেট খেলার মতো এত পছন্দের, এত ভালবাসার। তাদেরকে বলতে হবেনা, ভয় দেখাতে হবেনা, জোরাজুরি করতে হবেনা, পরীক্ষা দিতে হবেনা, আলাদা কোচিং করতে হবেনা কিন্তু তারা জানবে, পড়ালেখার প্রতি আলাদা টান আলাদ আগ্রহ থাকবে যা তাদের অভিভাবকদের বলে দিতে হবেনা, আপনা আপনিই কাজটি করবে। তারা লেখাপড়া প্রকৃত অর্থেই শিখবে।কিন্তু আমারা পরীক্ষা নিচিছ, পরীক্ষার পরিমাণ ও বহর বাড়াচিছ, তাদের চাপে রাখছি কিন্তু তারা কি শিখছে? যদি নাই শিখে তা হলে জাতীয় পর্যায়ে এত বিশাল আয়োজন করে পরীক্ষা নেওয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি? শিশুদের এই পরীক্ষার চিন্তা তাদেরকে পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দিচেছনা, টিভির কোন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখতে দিচেছনা, বিনোদনমূলক কোন কাজ করতে দিচেছনা, দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে দিচেছনা। সব সময়ই পরীক্ষার চিন্তা তাদের তারা করে বেড়াচেছ। বাবা-মাকে ব্যস্ত থাকতে হচেছ বাচচা পড়তে বসেছে কিনা, হোম ওয়ার্ক করেছে কিনা, গৃহশিক্ষকের কাছে বসেছে কিনা, কোচিংএ যাচেছ কিনা, কোচিংএর আলাদা হোমওয়ার্ক করেছে কিনা, মডেল টেস্ট দিচেছ কিনা ইত্যাদি। অর্থাৎ বাচচাদের সাথে সাথে অভিভাবকদেরকেও ব্যস্ত থাকতে হচেছ। পরিবারময় এ এক যন্ত্রণা। গত বছর অফিসিয়াল পিকনিকে আমার এক সহকর্মীর স্ত্রী অনেক বছর পর পিকনিকে এসেছেন। বললেন ”ভাই এই তের বছর পর পিকনিকে বা এই ধরনের অনুষ্ঠানে এসেছি। এতটা বছর বাচাচাদের পেছনেই ছিলাম, তাদের স্কুল কোচিং আর পড়াশুনা নিয়ে। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, এখন একটু সময় পেলাম অনুষ্ঠানে আসার। ” এটি কোন বিচিছন্ন ঘটনা নয়। এটি আমাদের সমাজের চিত্র। বাবা-মা সন্তানকে জিজ্ঞেস করছেনা সকালে ঘুম থেকে উঠেছে কিনা, ঘুম থেকে জেগে মুক্ত বাতাসে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করেছে কিনা, ব্যায়াম করেছে কিনা, টিভিতে কোন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখেছে কিনা, কোন বিনোদনমূলক নাটক বা অনুষ্ঠান দেখেছে কিনা বা দেখবে কিনা,বিকেলে মাঠে বা বাড়ীল ছাদে হাঁটাহাঁটি করেছে কিনা বা খেলাধুলা করেছে কিনা, মন খুলে কোন গান গাইছে কিনা বা মনে খুলে হেসেছে কিনা, পুরো জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারে কিনা, গুরুজনদের সালাম দেয় কিনা, সহপাঠীর সাথে ভালোভাবে মিশে কিনা। তারা শুধু জিজ্ঞেস করে স্কুলের ও কোচিংএর বা গৃহশিক্ষকের হোম ওয়ার্ক করেছে কিন।কোচিংএ কখন যাবে, কখন আসবে, গৃহশিক্ষকের কাছে কখন পড়তে বসবে, কোথায় কবে মডেল টেস্ট আছে , স্কুলের পরীক্ষা কবে, প্রস্তুতি কেমন, নিশ্চয়ই ভালোনা ইত্যাদি। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থী, শিশু, এবং সন্তানদের দ্বিতীয় ধরনের প্রশ্নুগুলোই বেশী বেশী করতে হবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে , প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরোনোর সাথে সাথে এ বিষয়গুলো পারতে হবে। তারা পেরেছে কিনা তা দেখার জন্য ’ ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট’ ব্যবহার করতে হবে তা হলে বুঝা যাবে যে, তারা বয়সের সাথে সাথে যেসব তাদের জানার কথা বা শেখার কথা সেগুলো শিখছে কিনা। আমরা যে অ্যাসেসমেন্ট করে থাকি তা হচেছ ’ সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট’। ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের এত টেনশন পোহাতে হবেনা, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কোন সুযোগ নেই, বাবা-মাকে এত ব্যস্ত থাকতে হবেনা, শিক্ষার্থীদের অর্ধচর্বন করে পড়া গিলে ফেলতে হবেনা যা আসলে হজম হচেছনা। তারা যতটুকা করবে বা শিখবে তা পুরোটাই ডাইজেস্ট হবে, তারা খাবারের প্রকৃত পুষ্টিই শরীরে গ্রহন করবে। আমরা সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট করছি বলে তারা বাংলা পড়তে পারছেনা কারন তাদের পরীক্ষায় তা আসেনি বা আসবে না। কাজেই তারা কিন্তু পড়া প্রতিবন্ধী হচেছ। গণিত বইয়ের বাইর থেকে কিছু দিলে তারা সেগুলোর সমাধান করতে পারছে না। গাণিতিক সমাধান যে তাদের করতে হবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগের জন্য তাতো তারা জানেনা ।কোমলমতি বাচচাদের প্রকৃত মানসিক , সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাস্তবজ্ঞান জানতে হলে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট চালু করতে হবে, বাদ দিতে হবে ’ সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট’ । ঘটা করে জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নিযে শিশু ও অভিভাবকদের ঘর্মাক্ত করার খেলা এবং প্রশ্নপত্রের সাথে জড়িত পুরো চক্রের অসাধু ব্যবসা এবং সর্বোপরি শিশুদের এত ছোট বয়স থেকেই একটি পুরোপুরো অনৈতিক খেলায় মাতিয়ে রাখা জাতীয়ভাবে বন্ধ করা উচিত এখনই। কারন যে পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষা হচেছ তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেই। যদি সঠিক শিক্ষাবিদদের কিছু পরামর্শ সঠিক অর্থে গ্রহন করা যায় তাহলে এ ব্যধি থেকে কিছুটা হয়ত মুক্তি পাওয়া যাবে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষাবিদ বা শিক্ষার সাথে প্রকৃত এবং নৈতিকভাবে যারা জড়িত তারা তাদের কথা তো শোনা হবেনা, কারন এখানেও তো রাজনীতির খেলা। জনাব জাফর ইকবাল তাঁর একটি নিবন্ধে যথার্থই বলেছেন ” শিক্ষানীতিতে নেই এরপরও এ দেশের ছেলেমেয়েদের ওপর জোর করে বাড়তি পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যদি এটা অনেক সুফল বয়ে নিয়ে আসত তা হলে কেউ কিছু বলত না, সবাই মেনে নিত। কিন্তু তা ঘটেনি। বাড়তি সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচেছ , কোথাও কোথাও শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্নের উত্তর ছাত্রছাত্রীদের পৌঁছে দিচেছন। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর শিক্ষক অভিভাবক সমান উৎসাহে সেই প্রশ্ন বের করে তাদের ছাত্রছাত্রী কিংবা সন্তানদের হাতে তুলে দিচেছন। শিশুরা অবাক হয়ে দেখছে তাদের শিক্ষকরা কিংবা তাদের বাবা-মায়েরা এক ধরনের অসৎ মানুষ। সেই শিক্ষক কিংবা বাব-মায়েরা তাদের সন্তানদের সমানে কেমন করে মুখ দেখান?” জনাব জাফর ইকবাল তাঁর একটি নিবন্ধে যথার্থই বলেছেন ” শিক্ষানীতিতে নেই এরপরও এ দেশের ছেলেমেয়েদের ওপর জোর করে বাড়তি পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যদি এটা অনেক সুফল বয়ে নিয়ে আসত তা হলে কেউ কিছু বলত না, সবাই মেনে নিত। কিন্তু তা ঘটেনি। বাড়তি সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচেছ , কোথাও কোথাও শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্নের উত্তর ছাত্রছাত্রীদের পৌঁছে দিচেছন। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর শিক্ষক অভিভাবক সমান উৎসাহে সেই প্রশ্ন বের করে তাদের ছাত্রছাত্রী কিংবা সন্তানদের হাতে তুলে দিচেছন। শিশুরা অবাক হয়ে দেখছে তাদের শিক্ষকরা কিংবা তাদের বাবা-মায়েরা এক ধরনের অসৎ মানুষ। সেই শিক্ষক কিংবা বাব-মায়েরা তাদের সন্তানদের সমানে কেমন করে মুখ দেখান?” সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি চায় তা হলে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষনে, মেধাবী শিক্ষক নিয়োগে, মেধাবী শিক্ষকদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিঁড়ি তৈরিতে, স্কুলগৃহকে আকর্ষণীয় করার জন্য ইনফ্রাস্কাট্রচার বানাতে ’ এবং এসব কাজে সরকারী-বেসরকারী উদ্যেগকে কার্যকরীভাবে কাজে লাগাতে। আমরা প্রায় দিনই দেখি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুদেরকে খোলা আকাশের নীচে কাস করতে কারন স্কুল গৃহ নেই, বা শিক্ষার্থীর সংকুলনা হচেছনা বিদ্যমান বিদ্যালয়ে গৃহে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোদের কারনে স্কুল গৃহের চাল উড়ে গেছে। অথচ পার্টিগতভাবে, জাতীয়ভাবে কত অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানে আমরা কত না অপব্যয় করে থাকি। ঢাকা সিটিতে সরকারী প্রাইমারী বিদ্যালয়ে আছে ২৯৯টি আর বেসরকারী ৫০০ এরও অধিক। সবচেয়ে নি¤œমানের পড়ালেখা হয় ঢাকা শহরের এই প্রাইমারী বিদ্যালয়গুলোতে, আর বেসরকারীগুলোতে অনেকটাই অগ্রগামী তবে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কি আমাদের শিশুশিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে? পাঠ্যসূচি, বিদ্যালয়ের ভেতরকার পরিবেশ, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, শিক্ষকদের শিক্ষাদান এবং আচরণ? এগুলোর কোনটিই কি আমাদের শিশুশিক্ষার্থী বান্ধব? এ প্রশ্নগুলো কি আমরা কখনও নিজেদের করছি? এগুলোর সমাধান কি আমরা খুঁজছি? প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে বাচচাদের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু, তারা সবকিছু ফেলে দেঁড়ে আসবে বিদ্যালয়ে। যেখান সরকার পাড়বে সে রকম আনন্দঘন শ্রেনিকক্ষ উপহার দিতে সরকার নিজেই করবে, যেখানে সম্ভব নয় সেখানে কমিউনিটি, বিত্তবান ব্যাক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালযগুলোকে শিশুবিকাশের যথাযথ স্থান হিসেবে তৈরি করতে হবে। সেখানে শেখানো হবে সকল ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড যেমন নাচ, গান, ছবি আঁকা, অভিনয় করা, পোষ্টার তৈরি করা, দেয়ালিকা প্রকাশ করা ইত্যাদি। থাকবে খেলাধুলার ব্যবস্থা। শিক্ষদের প্রশিক্ষণ থাকবে খেলাধুলার মাধ্যমে কিভাবে শেখানো যায় গণিত, বিজ্ঞান, ভাষা, দেশ ও বিদেশ। শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে যথাযথ, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারজন বা তিনজন শিক্ষক দিয়ে নয়, আট দশজন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের পরে প্রতি টার্মে একবার সম্ভব না হলে অন্তত বছরে একবার প্রাপ্ত প্রশিক্ষনের ওপর রিফ্রেশার্স করাতে হবে। সরকার সকলের জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে, ভাল কথা কিন্তু উপরোক্ত বিষয়গুলো আগে নিশ্চিত করতে হবে। যদি সম্ভব নাহয়, তাহলে বই বিতরণ সবার জন্য না করে শুধুমাত্র ভালনারাবল এলকায় বিতরণ করা যেতে পারে, তাতে অর্থ বেঁচে যাবে অনেক যা দিয়ে বিদ্যালয়ের পরিবেশ, শেখানোর ধরন এবং শিক্ষার্থীরা আসলেই শিখছে এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। তবেই প্রাথমিক শিক্ষা তাদের কাজে লাগবে। মাছুম বিল্লাহ : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্রাক শিক্ষা কর্মসূচি ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টিচার্স এসোসিয়েশন।

আরো দেখুন