Loading..

খবর-দার

২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০৪:৪৭ অপরাহ্ণ

মেক্সিকো '৮৬ ও ম্যারাডোনা ⚽⚽⚽⚽⚽⚽⚽⚽⚽

মেক্সিকো '৮৬ ও ম্যারাডোনা

⚽⚽⚽⚽⚽⚽⚽⚽⚽


আমাদের এলাকায় ১৯৮৬ সালে বিদ্যুৎ সংযোগ  ছিলোনা। তাই এখনকার মতো ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট টিভি থাকার প্রশ্নই ছিলোনা। এমনকি ব্যাটারীচালিত সাদা-কালো টেলিভিশনও তখন এ তল্লাটে কারো ছিলোনা। সুতরাং এলাকায় বাস করা আমাদের প্রজন্মের তরুণেরা মেক্সিকো '৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার একক নৈপূন্যের চোখ ধাঁধানো কসরত ও কারিকুরি দেখার সুযোগ ছিল না।  এ এলাকায় ম্যারাডোনার খেলা টিভিতে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ইটালিয়া '৯০ বিশ্বকাপ থেকে।


১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে আমি বরিশাল শহরের একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই। থাকতাম মামার বাসায় ওয়াপদা কলোনিতে। কলোনির সকল বাসায়ও তখন টিভি ছিলোনা। ওয়াপদা কলোনির টাইগার্স ক্লাবের পাশে কর্মচারী ইউনিয়নের একটি সাদাকালো টিভিই ছিল বাসায় টিভিহীন ফুটবল প্রেমিদের ভরসা। এছাড়াও অনেকে পাশের বাসায়, বন্ধুর বাসায় টিভিতে খেলা দেখতো। কলোনির ডি টাইপ কোয়ার্টারে কারো কারো রঙিন টিভি ছিল বলে শুনেছি। তখন বিটিভি তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্বকাপ ফুটবলসহ অন্যান্য বৈশ্বিক ইভেন্ট সরাসরি  সম্প্রচার করতো। 


এদেশের মানুষ ফুটবল খেলার সমঝদার বহুকাল ধরেই। '৯২ সালের বিশ্বকাপ বিটিভিতে সম্প্রচারের পরপরই ক্রিকেট সারাদেশে জনপ্রিয় হয়। এর আগে শহরাঞ্চল ব্যতীত ক্রিকেট খেলা কেউ বুঝতোও না,পছন্দও করতোনা। বিদেশে অনুষ্ঠিত খেলা সরাসরি  দেখার বড় হ্যাপা হলো সময়কাল। কারণ ভিন্ন ভিন্ন  গোলার্ধে, ভিন্ন টাইমজোনে  অনুষ্ঠিত খেলা আমাদের দেশে সরাসরি সম্প্রচারিত হলে বেশীরভাগই গভীর রাত অথবা ভোর রাতে সম্প্রচারিত হয়। ফুটবল উন্মাদনায় আপ্লূত তরুণদের কাছে এসব কোন ব্যাপার নয়। তো সেবারই আমি প্রথম আর্জেন্টিনা নামক দেশের কথা প্রথম শুনি। এর আগে অবশ্য বৃটেনের সাথে ফকল্যান্ড দ্বীপের মালিকানা নিয়ে আর্জেন্টিনা যুদ্ধে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পেয়েছে। 


ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিটি দেশই ফুটবলে কমবেশি শক্তিশালী। এ যাবৎ ৯ বার কাপ নিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকা। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, কেবল ম্যারাডোনার জন্যই আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ আর্জেন্টিনার ভক্ত হয়েছে। ম্যারাডোনার মেক্সিকো বিশ্বকাপের  খেলা যারা সরাসরি দেখেনি তারা মূলত শুনে শুনে ম্যারাডোনার ভক্ত হয়েছেন। ১৯৭৮,১৯৮২ বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনা স্কোয়াডে ম্যারাডোনা ছিলেন। ছিলেন ১৯৯০,১৯৯৪ বিশ্বকাপেও। কিন্তু ১৯৮৬ সালের জন্যই ম্যারাডোনার যতো নামডাক। '৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার '৮৬ র সামান্য ছোঁয়া ছিলো। খুড়িয়ে খুড়িয়ে টাইব্রেকের সৌভাগ্যে উঠেছিলেন ফাইনালেও। কিন্তু মেক্সিকান রেফারি কোডেসালের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে খেলার ৮৫ মিনিটে জার্মানির আন্দ্রে ব্রেহমের পেনাল্টিতে কার্ড জর্জর আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে পিছিয়ে যায়। দুর্ভাগ্য আর্জেন্টিনার, কারণ তখন VAR প্রযুক্তি ছিলনা। তবে ম্যারাডোনা আর ক্যানিজিয়ার যুগল রসায়নে ব্রাজিলকে হারানোর চমক '৮৬ র ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলো। আবার প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের কিংবদন্তি রজার মিলার এক বুদ্ধিদীপ্ত গোলে আর্জেন্টিনার পরাজয় এক স্মরণীয় ঘটনা হয়েই থাকবে।


'৯৪ ইউএসএ বিশ্বকাপে কোনঠাসা আর্জেন্টিনা  রশিদি ইয়াকিনির সুপার ঈগল নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ডু অর ডাই ম্যাচে  বাতিস্তুতা আর ম্যারাডোনার যৌথ প্রচেষ্টায় করা গোল আজও চোখে ভেসে উঠে। অবশ্য ততদিনে আমাদের এলাকায় ব্যাটারিচালিত  টিভি এসে গেছে। নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে জেতার পর ম্যারাডোনার গতি আর ড্রিবলিং দেখে কর্তৃপক্ষ সন্দেহবশত ডোপ টেস্ট করে। ফলাফল পজেটিভ আসলে তাৎক্ষণিকভাবে নিষিদ্ধ হন ম্যারাডোনা। কালো সানগ্লাসে লুকানো কান্নার অভিব্যক্তি সম্পন্ন গ্যালারীতে অবস্থান নেয়া ম্যারাডোনার সেই মুহুর্তটুকু ভুলতে পারবেনা কোন ম্যারাডোনা ভক্ত। পারবেনা '৯০ বিশ্বকাপে হেরে যাওয়ার পর ম্যারাডোনার কান্নার দৃশ্যের কথা ভুলতে।


এরপর কতো জল গড়িয়েছে। কেটে গেছে কতো বিশ্বকাপ ফুটবল।  '৯৮ বিশ্বকাপে এরিয়েল ওর্তেগা,হুয়ান ভেরন, ২০০২ বিশ্বকাপে হার্নান ক্রেসপো, ২০০৬ বিশ্বকাপে হ্যাভিয়ার স্যাভিওলা, তরুণ মেসি, রিকুয়েলমে, ২০১০ বিশ্বকাপে মেসি, তেভেজ, ২০১৪ বিশ্বকাপে মেসি, দি মারিয়া, ২০১৮ সালে মেসি, দিবালা,আগুয়েরো আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ মাতিয়েছেন। তাদের অনেকেই নতুন ম্যারাডোনা খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। যদিও তাদের সকলে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ছিলেন। তথাপি কেউই ম্যারাডোনার প্রভাব বলয়ের বাইরে আসতে পারেননি। আর্জেন্টিনায় কোনো নতুন প্রতিভা এলেই আজও তাঁকে ম্যারাডোনার সাথে তুলনা করা হয়। 


'৮৬ বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের ৬ জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে, শেষে গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে করা গোল, ফাইনালে ইংল্যান্ডের গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে  হাতের সাহায্যে করা গোল ( হ্যান্ড অব গড) চিরকাল ফুটবল প্রেমিদের মনে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। এদেশের সাধারণ মানুষের মনে ম্যারাডোনার অবস্থান কেমন তা জানার জন্য ৯০ সালে আমরা একটা জরিপ করেছিলাম সনাতন পদ্ধতিতে। যে সকল বয়স্ক লোকজন খেলাধুলা টিভিতে দেখেন না বা দেখার সুযোগ হয়নি এমনতরো লোকজনকে ধরে ধরে  ম্যারাডোনা কে, তা জানে কিনা  জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো। আশ্চর্যের বিষয় আমার এক খালু (অশীতিপর বৃদ্ধ) ঠিকই জবাব দিলেন। তিনি বললেন, হ জানিতো। ম্যারাডোনায় বল খেলে। 


ম্যারাডোনার কারণেই বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল প্রেমি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলকে '৮৬ পরবর্তী প্রতিটি বিশ্বকাপে সাপোর্ট করে আসছে। অখ্যাত ইটালিয়ান ক্লাব ন্যাপোলিকে ইউরোপিয়ান ক্লাব কাপ, ইটালিয়ান সিরি আ জিতিয়েছেন একাধিক বার। নেপলস্ বাসীর মতোই বিশ্বের কোটি ফুটবল ভক্তকে কাটিয়ে ম্যারাডোনা পাড়ি জমালেন পরলোকে। যদি পরলোকে কোনো ফুটবল টিম থেকে থাকে তাহলে তা যে সর্বকালের সেরা ফুটবলারকে পেয়ে স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ টিমে পরিণত হবে তা বলাই বাহুল্য!