সহকারী শিক্ষক
২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০৭:২৯ পূর্বাহ্ণ
গাছের ভেতর পানির কাণ্ড
গাছের ভেতর পানির কাণ্ড
আচ্ছা, গাছ এত লম্বা হয়
কীভাবে? কী আজব প্রশ্ন, তাই না! কোষ বিভাজনের মাধ্যমে, সেটা তো সবাই জানে।
প্রশ্নটা তাহলে অন্যভাবে করি, গাছ লম্বা হওয়ার অসুবিধা কী? আবার উদ্ভট প্রশ্ন!
লম্বা লম্বা গাছ আমাদের এত সুন্দর ছায়া দিচ্ছে, এখানে সুবিধা বৈ অসুবিধার তো কিছু
নেই। ব্যাপারটা হচ্ছে, গাছ লম্বা হলে মানুষ নয়, বৃক্ষ মহাশয় নিজেই বড় ঝামেলায় পড়ে
যান। যে গাছ যত লম্বা, তার তত বেশি বিপদ। রান্না করার সময় আমরা যে রকম কল খুলে
পানি নিয়ে আসতে পারি, গাছ বেচারার তো সেই সুবিধা নেই। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াটা
পাতায় ঘটে, সে জন্য সেই মাটির নিচ থেকে পানি টেনে পাতায় নিয়ে আসতে হয়। আর এখানেই
শুরু হয় বিপত্তি।
পানিকে যদি নিচ থেকে ওপরে
উঠতে হয়, তাকে অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। মানে অভিকর্ষজ বিভব শক্তি
প্রয়োগ করতে হবে। অভিকর্ষজ বিভব শক্তির মান mgh, যেখানে m হচ্ছে পানির ভর, g
অভিকর্ষজ ত্বরণ এবং h যতটুকু উচ্চতায় পানি ওঠাতে হবে। তার মানে উচ্চতা যত বেশি
হবে, পানি ওঠানো তত কষ্ট। সাধারণত গাছের উচ্চতা ৩২ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত হয়। কিছু
কিছু গাছের উচ্চতা ২০০-৩০০ ফুট ছাড়িয়ে যায়।
গাছের মূল থেকে এত ওপরে
কাণ্ড পর্যন্ত পানি কীভাবে পরিবাহিত হয়, তা নিয়ে বেশ কিছু ধারণা আছে। তার মধ্যে
একটি হচ্ছে অভিস্রবণ-প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় পানি কম ঘনত্বের দ্রবণ (যেখানে পানির
পরিমাণ বেশি) থেকে বেশি ঘনত্বের দ্রবণের (পানির পরিমাণ কম) দিকে প্রবাহিত হয়।
যেহেতু মাটির নিচে পানির
ঘনত্ব গাছের ভেতরের কোষ থেকে বেশি, পানি অনায়াসে মাটি থেকে কোষে প্রবেশ করতে
পারে-এ কথাটা আংশিক সত্যি। আসলে অভিস্রবণ-প্রক্রিয়া পানিকে খুব একটা বেশি ওপরে
টানতে পারে না। কারণ, পানি একবার কোষে প্রবেশের পর কোষ থেকে কোষে পানির ঘনত্বে
এতটাও পার্থক্য থাকে না যে পানি সমঘনত্ব বজায় রাখতে ওপরের দিকে যাবে।
আবার আমরা লবণাক্ত মাটিতে
জন্মানো গাছের কথা তো ভুলেই যাচ্ছি। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মাটির নিচের পানি অনেক
লবণাক্ত। তাই এই প্রক্রিয়া মেনে নিলে অভিস্রবণ-প্রক্রিয়া পানিকে ওপর থেকে নিচের
দিকে যেতে বাধ্য করবে। তার মানে ওখানকার গাছের পানি ওঠাতে অভিকর্ষজ শক্তি প্রয়োগ
করা তো লাগবেই, সঙ্গে অতিরিক্ত শক্তি লাগবে পানির নিচে যাওয়া থামাতে। বিপদ না কমে
বরং বেড়ে গেল!
ঠিক আছে,
অভিস্রবণ-প্রক্রিয়া বাদ। তাহলে পানি নিশ্চয়ই কৈশিকতার কারণে (ক্যাপিলারি অ্যাকশন)
পরিবাহিত হয়। কৈশিকতা কী, তা বোঝার জন্য বাসায় ছোটখাটো একটা পরীক্ষা করা যায়।
অর্ধেক গ্লাস পানির মধ্যে একটা স্ট্র ডোবাতে হবে। দেখা যাবে, স্ট্রয়ের ভেতরের
পানির উচ্চতা গ্লাসের ভেতরের পানির উচ্চতা থেকে কিছুটা বেশি। নল যত চিকন হবে,
পানির স্তর তত ওপরে উঠবে।
গাছের ভেতরে প্রতিটা কোষে
পানি পৌঁছানোর জন্য রয়েছে লম্বা, সরু ২০-২০০ মাইক্রোমিটার ব্যাসওয়ালা, চুলের মতো
চিকন জাইলেম টিউব। কিন্তু অনেক খাটাখাটনি করে অঙ্ক কষে দেখা গেছে, জাইলেম টিউব এত
সরু হওয়া সত্ত্বেও তার পক্ষে ১ মিটারের (৩ ফুট) বেশি ওপরে পানি তোলা সম্ভব নয়।
কোথায় ৩০০ ফুট আর কোথায় ৩ ফুট! তাহলে তো গাছ বেচারা পানির অভাবেই মারা যাওয়ার কথা।
গাছের পত্ররন্ধ্রের
মাধ্যমে ৯৫ ভাগ পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায়
বাকি রইল প্রস্বেদন। এ
প্রক্রিয়ায় গাছ যে পরিমাণ পানি শোষণ করে, তার মাত্র ৫ শতাংশ সালোকসংশ্লেষণ ও
অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে। বাকি ৯৫ শতাংশই বাষ্পাকারে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। পানি
বাষ্পীভূত হওয়ার কারণে গাছের পাতা ও কাণ্ডে চাপের পরিমাণ মূলরোমের চাপ থেকে
অনেকখানি কমে যায়। ব্যাপারটা কল্পনা করা যায় স্ট্র দিয়ে সেভেনআপ খাওয়ার মতো।
স্ট্রকে সেভেনআপের বোতলে ঢুকিয়ে আমরা যখন জোরে টান দিই, তখন আর কিছুই না, মুখের
ভেতরে নিম্নচাপ সৃষ্টি করি মাত্র। তরল আপনাআপনি বোতল থেকে মুখে এসে ঢোকে। কিন্তু
ওই যে বললাম, গাছের উচ্চতাই তার বিপত্তির কারণ। ধরা যাক, গাছের গোড়ায় চাপ ১
অ্যাটমসফিয়ার বা ১০১৩২৫ প্যাসকেলের কাছাকাছি। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, আগায়
চাপ কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে, চাপের এই পার্থক্যও পানিকে ১০ মিটারের
বেশি ওঠাতে পারার কথা নয়।
PLower
- Pupper = hρg
h
= (PLower - 0)/ρg
h
=101325/(1000×9.8)
h
=10.33 m
মজার
ব্যাপার হচ্ছে, শেষ মানটা কিন্তু প্রস্বেদনই দেয়। তবে এইমাত্র যে হিসাব করলাম?
ওখানে আসলে আমরা গাছের কাণ্ডের কিংবা পাতার ভেতরের আসল চাপের মান বসাইনি। পানি
ওপরে ওঠাতে গেলে চাপের পার্থক্য বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? সম্ভব, গাছ
যদি তার পাতায় ঋণাত্মক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে।
ঋণাত্মক চাপ ব্যবহারের
মাধ্যমে গাছ মূল থেকে পাতায় পানি তুলে আনে
একটি
কণা বল যত কম প্রয়োগ করবে, চাপ তত কমবে। যখন কোনো কণা থাকবে না, চাপও শূন্য হয়ে
যাবে, তাই না? এই তত্ত্ব শুধু গ্যাসীয় কণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কঠিন পদার্থের
ক্ষেত্রে চিন্তা করা যাক—একটা রাবারকে সংকুচিত করার জন্য যে চাপ
দিচ্ছি, তা যদি ধনাত্মক চাপ হয়, ওই রাবারকে টেনে লম্বা করার জন্য প্রয়োগকৃত চাপই হচ্ছে
ঋণাত্মক চাপ। তরল পদার্থের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু কঠিন। তরল পদার্থের চাপ শূন্যে
নামামাত্র তা বুদবুদ আকারে বাষ্পীভূত হওয়া শুরু করে। পদার্থকে এক অবস্থা থেকে অন্য
অবস্থায় রূপান্তরিত করতে শুধু চাপ বা তাপমাত্রা পরিবর্তন করলেই হয় না, সক্রিয়করণ
শক্তির (Activation energy) প্রয়োজন পড়ে। পানিকে এই সক্রিয়করণ শক্তির জোগান দিতে
প্রয়োজন হয় বায়ুর বুদবুদের। গাছের জাইলেম টিউব পুরোপুরি পানিপূর্ণ থাকার কারণে সেই
বুদবুদ তৈরির কোনো অবকাশ থাকে না; যে কারণে চাপ শূন্যের নিচে নামা সত্ত্বেও পানি
বাষ্পে পরিণত না হয়ে অতিশীতল অবস্থায় (Supercooled water) চলে যায়। এ অবস্থায়
কিন্তু পানি তরলই থাকে।তার মানে পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে ৯৫ ভাগ পানি বাষ্পীভূত হয়ে
যায়। বাকি ৫ ভাগ পানির কণার আন্ত-আণবিক আকর্ষণ এত বেশি বেড়ে যায়, তারা উল্টো দিকে
চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে। ৩০ ফুট থেকে বেশি উচ্চতার যেকোনো গাছ গড়ে ১৫
অ্যাটমসফিয়ারের মতো ঋণাত্মক চাপ তৈরি করতে পারে, যে প্রক্রিয়া মানুষের বের করতে
রীতিমতো কালো ঘাম ছুটে গেছে! চিন্তা করা যায়, জাইলেম টিউবের মুখে বিশাল মাপের
ঋণাত্মক চাপ তৈরি হচ্ছে মূল থেকে শত শত ফুট ওপরে পানি ওঠানোর জন্য। এ পানির বুদবুদ
করে ফোটার কথা কিন্তু ফুটতে পারছে না; কারণ, জাইলেম টিউবে বায়ুর বুদবুদ তৈরি হওয়ার
কোনো উপায় নেই! সেই পানির মাত্র ৫ ভাগ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরিতে
সাহায্য করছে। আর বাকি ৯৫ ভাগ পত্ররন্ধ্রের মধ্য দিয়ে বাষ্পীভূত হচ্ছে, যাতে বাকি
কণাগুলো ঋণাত্মক চাপ তৈরি করতে পারে। কিসের জন্য? যাতে গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইডের
কিছু অণু গ্রহণ করে মানুষের জন্য অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। আর এসব কিছু ঘটছে
আপনার বাড়ির পাশে দাঁড়ানো সবুজ পাতায় ছাওয়া ওই গাছের ভেতরে।