সহকারী শিক্ষক
২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ১১:০৯ অপরাহ্ণ
মিরহুম প্রফেসর আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল বারী সাহেবের জীবন ও ধর্মভিত্তিক স্মারক গ্রন্থ
অধ্যাপক আব্দুল বারী স্যারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা
জগতের চিরন্তন নিয়ম মেনে খুব নিরবে 28 আগস্ট 2020 চলে গেলেন সুনামগঞ্জের অন্যতম বাতিঘর অধ্যাপক আব্দুল বারী স্যার। 29 আগস্ট 2020 সকালবেলা ফেসবুক খুলেই দেখি স্যারের মৃত্যুর সংবাদ । স্যারের সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৯৩ সালের 29 সেপ্টেম্বর। একাদশ শ্রেণির প্রথম দিনের ক্লাসে। কলেজের প্রথম দিন যে স্যারদের সাথে দেখা তার মধ্যে অন্যতম হলেন জনাব সিতেশ রঞ্জন আচার্য স্যার, নন্দলাল শর্মা স্যার, বাবু অরুণ চক্রবর্তী স্যার, জনাব আব্দুস সুবহান স্যার ও জনাব আব্দুল বারী স্যার প্রমুখ । সব স্যারের পাণ্ডিত্য এবং তাদের ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তবে একটি বিষয় আমার ধারণার অতীত হলো। আমি ভাবতাম কলেজের অধ্যাপক বৃন্দ হবেন খুব গম্ভীর -রাশভারী। কিন্তু না, আমি লক্ষ করলাম আমাদের স্যারগণ খুবই অমায়িক, ধৈর্যশীল ও প্রাণখোলা ।ক্লসে এলেন বারী স্যার। বিশাল দেহের একজন ভদ্রলোক। প্রথম দেখে ভরকে যাবার মতো । কিন্তু না। তিনি খুব সহজ করে দিলেন আমাদের। কলেজের বেশ কিছু নিয়ম কানুন বললেন। আর ঘোষণা দিলেন আমাদের স্বাধীনতার যা স্কুল জীবনে অকল্পনীয় ছিলো। বারী স্যার আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। বললেন তোমার ভালো লাগলেই কেবল তুমি ক্লাসে থাকবে, ভালো না লাগলে ক্লাসে থাকার প্রয়োজন নেই। ইতিহাস এমন কোন কঠিন বিষয় নয়। নিজেরা পড়েও পরীক্ষায় ভালো লিখা যায়। কিন্তু আমার কাছে ইতিহাস একটি কঠিন বিষয় মনে হতো। বিশেষ করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানের নাম, ঐতিহাসিকগণের নাম, প্রচ্য ও পাশ্চাত্যের শাসকদের নাম, দিন তারিখ। এই বিষয়গুলো আমি একদম স্মরণ রাখতে পারতাম না। যার ফলে ইতিহাস পড়তে আমার খুব ভালো লাগত না। স্যার ইতিহাসের প্রতিটি বিষয় গল্পের মতো করে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যেন একজন দাদু নাতি নাতনীদের সাথে গল্প করছেন ফেলে আসা অতীতের । ফলে বিষয়টি সহজ হয়ে যেত। এছাড়া ইতিহাস পড়ার উদ্দেশ্যও সফল হতো। অনেকদিন স্যারের সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না। একদিন প্রসঙ্গক্রমে স্যারের সাথে দেখা।পরিচয় দিয়ে জানালাম বর্তমানে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। স্যার খুব খুশি হলেন। বললেন, তিনি এস এস সি 1962 ব্যচে জুবিলীর ছাত্র ছিলেন।১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ সম্পন্ন করেন। জুবিলী স্কুলের একজন শিক্ষক অনেক কিছু। এটা অনেক সম্মানের।
স্যারের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠতা হয় গতবছর ২০১৯ সালে । স্যারের নাতি তালহাকে জুবলিতে ভর্তি করাতে চান। যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র। তথাপি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য তিনি কিছুটা শঙ্কিত। আমার বাসার খোঁজ নিয়ে তিনি একদিন এলেন নাতিকে নিয়ে। সেদিন স্যার তাঁর জীবনের অনেক কথা বলেন। বললেন, জীবনের অনেক বাঁক থাকে। খুব কম মানুষই জানে আসলে সে কি হবে। তিনি মূলত রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিলেন। সমাজসেবক। লেখাপড়া শেষে তিনি দুয়েকবার স্থানীয় নির্বাচন করেছেন। আইনজীবী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সুনামগঞ্জ বারে। এ সময় কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপকের পদ শুন্য ছিলো। অনিচ্ছা সত্বেও তৎকালীন এস ডি ও এর অনুরোধে অতিথি প্রভাষক হিসেবে ১৯৭৭ সালে যোগদেন সুনামগঞ্জ কলেজে। তখনও কলেজটি জাতীয়করণ হয় নি। কিন্তু অচিরেই প্রেমে পড়ে যান শিক্ষকতার। কিভাবে যে কেটে গেল কয়েকটি বছর! বুঝতে পারবেন পারলেন না। এরমধ্যে ১৯৮০ সালে কলেজের জাতীয়করণ হয়ে গেল। আর কোথায় যাবেন! স্থায়ীভাবে অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি 2004 সালে সুনামগঞ্জ থেকে অবসরগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ পৌর কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবেও বেশ কক'বছর দায়িত্ব পালন করেন। জনসেবা ও রাজনীতির প্রতি ঝোঁক থাকলেও আত্ম প্রচারণায় খুবই নির্মোহ ছিলেন তিনি সবসময়। আমার আর স্যারের বয়সের পার্থক্য 30 বছর। অথচ কথা বললে আমি কখনই এই ব্যবধান খুঁজে পাইনি। স্যার আমাকে সরাসরি কোনো উপদেশ দিয়েছেন খুবএকটা মনে পড়ে না। নিজের জীবনের কথা বলেছেন। পারিপার্শিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাতেই আমার জন্য যে অমূল্য উপদেশ তিনি রেখে গেছেন তার কোন তুলনা নেই। 'উপদেশ অপেক্ষা দৃষ্টান্ত ভালো' স্যার যেন তারই চর্চা করে গেলেন। এই গুনি শিক্ষক সম্বন্ধে স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতা জীবনে আব্দুল বারী স্যারের মত প্রচার বিমুখ, মিতভাষী, নিরাভরণ, নির্মোহ, ধর্মপ্রাণ, পরোপকারী, বিদগ্ধ একজন শিক্ষক যা দিয়ে যায়, সীমিত পরিসরে এর বর্ণনা অসম্ভব। তাঁর থেকে আমি যা পেয়েছি এর তো কোন বিনিময় নেই। পরম করুণাময়ের নিকট প্রার্থনা তিনি যেন আমার স্যারকে পরকালে এর বিনিময়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। আর আমাদেরকেও এই তৌফিক দান করেন, আমরাও যেন এই ধারাবাহিকতায় সমাজে আলোক বিতরণে ব্রতী হতে পারি। উপদেশ নয় বরং উদাহরণের মাধ্যমে উত্তম মানবিক গুণ সম্পন্ন মানুষ গড়ায় নিবেদিত হতে পারে। পরিশেষে আমার এই লেখার মাধ্যমে স্যারের স্মৃতির প্রতি নিবেদন করি পরম শ্রদ্ধা। পরিবার-পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা। আর মাগফেরাত কামনা করি তাঁর বিদেহী আত্মার।
আমিন।
লেখক ঃ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)
সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ।