Loading..

খবর-দার

২৮ ফেব্রুয়ারি , ২০২১ ০৭:২২ অপরাহ্ণ

উচ্চশিক্ষার নীতিমালা ঢেলে সাজাতে হবে

জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ভবনগুলোর দরজায় তালা ঝুলেছিল ২০১৯ সালে। মেইন গেট ছিল বন্ধ। কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারায় টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চে ধুলাবালির আস্তরণ জমেছিল। করোনার কারণে ২০২০ সালটা নানা বিষের জ্বালার মধ্যে কোনদিক দিয়ে যেন নিমেষেই পার হয়ে গেছে। শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, এখন ২০২১ সালের দুটো মাস চলে যাওয়ার সময় হয়ে আসতেই শিক্ষার্থীদের ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেছে। গ্রামগঞ্জের মধ্যে নেট সুবিধাবিহীন অবস্থায় থেকে অনেকের অনলাইন ক্লাসগুলোতেও অংশ নেওয়া হয়নি। বাড়ির কৃষিকাজেও মন বসে না। সারা দিন ভবঘুরের মতো এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে আর কতদিন বাড়িতে বসে কাটানো যায়?

দেশে করোনার মধ্যেও সবকিছুই খোলা আছে। শুধু শিক্ষার মতো অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানের ফটকে তালা মেরে রাখা হয়েছে, সঙ্গে আবাসিক হলগুলোয়ও। এদিকে বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাই ক্যাম্পাসের আশপাশে বন্ধুদের মেস, বাসাবাড়িতে ঠাঁই নিয়ে কোনোরকমে পরীক্ষার কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য ডিভাইস দেওয়ার কথা থাকলেও কেউ সেটি পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

এখন প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হল খোলার জন্য টালবাহানা চলছে। তার মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণায় জানানো হলো, আরও প্রায় তিন মাস পর হল (মে ১৭, ২০২১) খোলা হবে, ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া হবে। অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে ভাইভাসহ নানা পরীক্ষা চলছে।

হঠাৎ এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। অনেক হলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তালা ভাঙতে দেখা গেল। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েদেরও তালা ভেঙে হলে ঢুকতে দেখা গেল। তারা শিক্ষালাভের জন্য ক্লাসে যেতে চায়, পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে কাজ পেয়ে দ্রুত সাবলম্বী হতে চায়।

বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ভিসির বাসার সামনে বসে জটলা করে হইচই করছে। কেউবা সুর করে স্লোগান তুলে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেউ বলছেন, প্রভোস্টের পদত্যাগ চাই। কেউবা বহিষ্কার চাইছেন। কেউ আবার বলছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সবকিছু খোলা রাখা হলেও শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

কারণ, দেশে করোনায় কজন মানুষ মরছে? তার চেয়ে হার্ট অ্যাটাক ও আÍহত্যা করে প্রতিদিন দ্বিগুণ-তিন গুণ বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। তবে যে যেভাবেই বলুক না কেন, সবই শিক্ষালাভের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হল খুলে দেওয়া, দ্রুত পরীক্ষা নেওয়াকে কেন্দ্র করেই বলা।

এদিকে করোনার জন্য সামনে কবে কখন কী হবে, কেউ তা জানে না। সবাই হতাশ। কারণ, বলা হচ্ছে-টিকা প্রদান শুরু হলেও সেটা এখনো গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া নতুন করোনার জন্য অনেক দেশে নতুন ভীতি তৈরি হয়েছে। করোনাকে ছাপিয়ে দেশে এখন ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক সময় সেখানকার দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবি তুলে রাস্তায় নেমে পুলিশের গুঁতো খেতে হচ্ছে আর সরকারি দলের সহপাঠীদের সঙ্গে মারামারি করে সময় পার করতে হচ্ছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার পড়াশোনা-গবেষণা লাটে উঠে ভেংচি কেটে সবাইকে পরিহাস করে চলেছে কোথাও কোথাও। আমরা সবাই লাজ-লজ্জা ভুলে এসবের মজা দেখি-এ কেমন পরিবেশে বাস করছি আমরা? কারও যেন কোনো দায় নেই। সবকিছু যেন চোখ বুজে সয়ে যেতে হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেক সময় এসব সংবাদ দেখে নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা করে।

বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে সুবিধাপ্রাপ্ত ছাত্র নামধারী একদল দুর্বৃত্তের চাঁদাবাজি ও বখরা পেতে লাগামহীন দৌরাত্ম্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চরম অশান্ত করে তোলে। খোলা না থাকলেও নির্মাণকাজ তো আর বন্ধ নেই। সম্প্রতি দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় স্থানীয় রাজনীতির ধারক ও বহিরাগত শিক্ষার্থীদের একটি সেকশন খুব বেপরোয়া। তারা সামান্য স্বার্থের জন্য শিক্ষক ও অফিসারদের প্রতি খারাপ আচরণ করতে মোটেও কুণ্ঠিত হয় না।

দুবছর আগে রাজশাহী পলিটেকনিকের প্রিন্সিপাল সাহেবকে সবার সামনে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে চ্যাংদোলা করে পুকুরে নিক্ষেপ করেছিল ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত। ভাগ্যিস তিনি সাঁতার জানতেন। তা না-হলে ২০-২৫ ফুট পানিতে তলিয়ে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হতো। আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের এ নৈতিক অধঃপতন কেন হলো, তা ভেবে দেখার বিষয়।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও অপরাজনীতি আজ সুনীতিগুলোকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে অট্টহাসি হাসছে, যা মোটেই কাম্য নয়। এর অবসানকল্পে স্বার্থপর ব্যবসায়ীদের বড় বড় দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কহীন, নৈতিকতার মানদণ্ডে অনুত্তীর্ণ দলকানা চাটুকারদের উপাচার্য, প্রিন্সিপালের দায়িত্ব দিলে চলবে না। প্রকৃতপক্ষে দেশের জন্য চিন্তাশীল মানুষ দরকার। জাতির সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য প্রয়োজন নীতিবান গবেষক দলের। চিন্তা ও গবেষণা ব্যতিরেকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলো তাই তো অসাড় হয়ে পড়েছে।

বর্তমান বাস্তবতায় করোনার দীর্ঘ ছুটির একঘেয়েমিতে মনোবৈকল্যের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এ নাজুক প্রেক্ষাপটে পাবলিক-প্রাইভেট সব বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে হলে দল-মত হিসাব না করে হীন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। দেশের সবকিছু খোলা রেখে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটাকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে মানুষ কোথাও স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ঘেঁষাঘেষি করে চলাফেরা করছে, কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে।

তদুপরি দেশে করোনার প্রকোপ তেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি। এরপরও করোনার দোহাই দিয়ে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটা দুর্ভাগ্যজনক। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের এক কর্মসূচিতে অভিযোগ শোনা গেল-ওদের কোনো এক ব্যাচের মাস্টার্সের সব পরীক্ষা শেষ হয়েছে; শুধু একটি মাত্র পরীক্ষা বাকি আছে।

তারা গণমাধ্যমকে বলেছে, এমন অবস্থায় পুনরায় তিন মাসের জন্য ছুটি বাড়িয়ে হঠাৎ সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়াটা চরম হঠকারী সিদ্ধান্ত। এমন খামখেয়ালিপূর্ণ ঘোষণার জন্য ওই শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে দলবেঁধে রাস্তায় নেমে পড়েছে। অন্যদিকে আবাসিক হল খোলা না থাকায় তারা বাড়ি ছেড়ে মেসে গাদাগাদি করে সময় পার করছে, যেখানে কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই।

দেশে এখন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বেড়েছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। এদের শিক্ষা সংক্রান্ত চাহিদা বেশি, জোগান অনেক কম। তাই তাদের দাবি-দাওয়া বেশি এবং তা বহুলাংশে উপেক্ষিত। আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যে বৈশ্বিক মানের উন্নত ব্যবস্থাপনা দরকার, তা মোটেও চোখে পড়ে না; বরং বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে সেখানে প্রাচীন ধারণার ব্যবস্থাপনা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা এখনো দলীয় রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ।

একটি স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দাবি ও প্রয়োজনকে রাজনৈতিক শিকলের দোহাই দিয়ে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানরা সেখানে নতজানু। কারণ, তারা অনেকেই একটি অভিন্ন প্রতিযোগিতাপূর্ণ একাডেমিক প্রতিভার ফসল হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত না হয়ে ব্যক্তিগত দৌড়ঝাঁপে বিজয়ী হয়ে ভিন্ন নীতিতে নিয়োগ পেয়েছেন।

তাই তারা শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদার কথা না ভেবে নিয়োগকর্তার ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। ফলে কোথাও দেখা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ কড়া নির্দেশ দিলেও শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে জ্যাম তৈরি করছে, কোথাও আবাসনের অপরিহার্যতার দাবি সামনে রেখে হাতুড়ি দিয়ে হলের তালা ভেঙে ফেলছে। এ অবস্থা নিরসনে উচ্চশিক্ষার নীতিমালা ঢেলে সাজাতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণাও করা হয়। উন্নত বিশ্বে যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, সেগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ ও গবেষণা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমন্বয় ও দায়বদ্ধতা থাকে। ফলে তাদের উন্নয়ন কাজে জবাবদিহি তৈরি হয় ও অপচয় কম হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের যোগসূত্র অদ্যাবধি তৈরি হয়নি। এ যোগসূত্র তৈরি করা জরুরি।

 

লেখক : ড. মো. ফখরুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান