সিনিয়র শিক্ষক
০১ মে, ২০২১ ০৯:৪৯ পূর্বাহ্ণ
আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস কি এবং কেন?
আর্ন্তজাতিক
শ্রমিক দিবস বা মে দিবস কি এবং কেন?
সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই কর্ম বিভাজন শুরু হল। এক শ্রেণি কৃষিকাজে
নিয়োজিত শ্রমিক ও অপর শ্রেণি ভূস্বামী বা জমির মালিক। ধীরে ধীরে সমাজে তৈরি হয়ে
গেল শ্রেণি বৈষম্য। কিছু সুবিধাভোগী মানুষ এটা বেশ বুঝে গেলেন, বিনা পরিশ্রমে কেবল
বুদ্ধি খাটিয়ে অপরের শ্রমের উপরে নির্ভর করে দিব্যি সুখে থাকা যায়। এই ধারণা থেকেই
পরবর্তী কালে বিশেষত প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় দাসপ্রথা গড়ে উঠেছিল।
ক্রমশ বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে উন্নত ও পরে স্বল্পোন্নত
দেশগুলিতে কলকারখানা গড়ে উঠল। সেই সব জায়গায় রুটিরুজির জন্য বহু শ্রমিক নিয়োজিত
হলেন। বহু দশক জুড়ে এ ধরনের শ্রমিকদের নির্দিষ্ট শ্রমদিবস ছিল না। মালিকের
প্রয়োজন অনুযায়ী, তাঁদের কাজ করতে হত। দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় পারিশ্রমিক ছিল
নগণ্য। উনবিংশ শতকের শেষার্ধে এ ধরনের শ্রমজীবী মানুষেরা প্রাণের দায়ে ক্রমশ
একত্রিত হতে থাকলেন। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দানা বাঁধতে বাঁধতে ধীরে ধীরে
শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন বাড়তে থাকল। আমেরিকায় শ্রমিকদের মধ্যে থেকে গড়ে উঠল
সমাজবাদী, বামপন্থী, ট্রেড ইউনিয়ন, ক্লাব ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা সচরাচর মে দিবস নামে অভিহিত। প্রতি বছর পয়লা মে তারিখে বিশ্বব্যাপী
উদযাপিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে
শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে
দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১লা মে জাতীয় ছুটির দিন।
আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
মে দিবসের পূর্ব ইতিহাসঃ
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উত্তর গোলার্ধে মে মাসের প্রথম দিবসটি
উদ্যাপিত হত ‘বসন্ত আবাহন দিবস’ উপলক্ষে। যার মধ্যে এই ব্যঞ্জনা নিহিত ছিল যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন
তীব্র শীতের অবসানে একটু উষ্ণতার উৎসব। বিশেষত, কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষদের কাছে
বসন্তের আগমন ছিল ঈশ্বরের আগমনের মতো। যাঁরা প্রাসাদ বা দুর্গে বসবাসের সুযোগ থেকে
বঞ্চিত ছিলেন এবং নিতান্ত কুটিরে বসবাস করতেন, এটা ছিল তাঁদের কাছে এক পরম পাওয়া।
পক্ষান্তরে দক্ষিণ গোলার্ধে এর বিপরীত অর্থাৎ, গ্রীষ্মের অবসানে
শীতের আবাহন হিসেবে ‘মে দিবস’ পালিত হতো।
মে দিবসের ইতিহাস :
১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার মেহনতী শ্রমিকশ্রেণী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের
দাবীসহ আরো কয়েকটি ন্যায্য দাবী ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবন বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীর
ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ১লা মে’র ঐ ধর্মঘট দিবসের আগে
যুক্তরাষ্ট্র বা বিশ্বের কোথাও শ্রম আইন ছিল না। শ্রমিকদের মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকার
বলতেও কিছু ছিল না। তারা ছিল মালিকদের দাস মাত্র। তাদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা
ছিল না। ছিল না সাপ্তাহিক কোন ছুটি। ছিল না চাকুরীর স্থায়িত্ব ও ন্যায়সঙ্গত মজুরীর
নিশ্চয়তা। মালিকরা তাদের ইচ্ছামত শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। এমনকি দৈনিক ১৮-২০
ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতেও বাধ্য করত শ্রমিকদের। এ অন্যায়, বঞ্চনা ও যুলুমের বিরুদ্ধে
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা পর্যায়ক্রমে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এ আন্দোলনের অংশ হিসাবে
‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’-এর ১৮৮৫ সালের সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দৈনিক
৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৬ সালের
১লা মে আমেরিকা ও কানাডার প্রায় তিন লক্ষাধিক শ্রমিক শিকাগোর ‘হে মার্কেটে’
ঢালাই শ্রমিক, তরুণ নেতা এইচ সিলভিসের নেতৃত্বে এক বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে সর্বপ্রথম
সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘট পালন করে। শ্রমিকদের সমাবেশ চলাকালে মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী
পুলিশ ও কতিপয় ভাড়াটিয়া গুন্ডা সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে অতর্কিতভাবে গুলী চালিয়ে ৬
জন শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা ও শতাধিক শ্রমিককে আহত করে। কিন্তু এতেও শ্রমিকরা দমে
যায়নি। শ্রমিকদের ইস্পাতকঠিন ঐ সফল ধর্মঘটের কারণে কোন কোন মালিক ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের
দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। ফলে শ্রমিকরা আরো উৎসাহী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে এবং সর্বস্তরে
৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২রা মে রবিবারের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনের
পর ৩ তারিখেও ধর্মঘট অব্যাহত রাখে।
ঐ নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত ৪ঠা মে শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটের
বিশাল শ্রমিক সমাবেশে আবারো মালিকগোষ্ঠীর গুন্ডা ও পুলিশ বাহিনী বেপরোয়াভাবে গুলী বর্ষণ
করে। এতে ৪ জন শ্রমিক নিহত ও বিপুল সংখ্যক আহত হয়। রক্তে রঞ্জিত হয় ‘হে’ মার্কেট চত্বর। গ্রেফতার করা হয় শ্রমিক
নেতা স্পাইজ ও ফিলডেনকে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর শ্রমিক নেতাদের
বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে রীতিমত ‘চিরুনী অভিযান’ চালিয়ে শিকাগো শহর ও এর আশপাশের এলাকা
থেকে গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ফিশার, লুইস, জর্জ এঞ্জেল, মাইকেল স্কোয়ার
ও নীবেসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক নেতাকে।
পরবর্তীতে শ্রমিকদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতাকারী মালিকপক্ষের
ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জুরি’ গঠন করে ১৮৮৬ সালের ২১ জুন শুরু করা হয় বিচারের নামে প্রহসন।
একতরফা বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর ঘোষিত হয় বিচারের রায়। রায়ে বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে শ্রমিক নেতা
পার্সন্স, ফিলডেন, স্পাইজ, লুইস, স্কোয়ার, এঞ্জেল ও ফিশারের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ প্রদান
করা হয় এবং ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর সে আদেশ কার্যকর করা হয়। শ্রমিক নেতা ও কর্মী
হত্যার এ দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয়
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে প্রতিবছর ১লা মে ‘শ্রমিক হত্যা দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক
সংহতি দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কার্য সময় ও সপ্তাহে
এক দিন সাধারণ ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করে প্রথম শ্রম আইন প্রণীত হয়। অন্যদিকে নারকীয়
এ হত্যাযজ্ঞ গোটা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকারে এনে দেয় নতুন গতি। শিকাগো শহরে সৃষ্ট এ
আন্দোলন ক্রমশ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। পৃথিবীর সকল শ্রমজীবী মানুষ এ আন্দোলনের
সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগানটি। সেই
সাথে ১২৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া সে ঘটনাটির কথা এখন প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে
স্মরণ করা হয়ে থাকে ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ বা ‘মে দিবস’ হিসাবে।
আসুন আমরা শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সদয় হই। তাদের প্রাপ্য অধিকার
থেকে তাদেরকে বঞ্চিত না করে তাদের মুখে একটু হাসি ফুটানোর ব্যবস্থা করি।
মোঃ
হাবিবুল্লাহ্
সহকারী
শিক্ষক(আইসিটি)
কনেশ্বর
এস.সি.এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন
ডামুড্যা,
শরীয়তপুর।
জেলা
অ্যাম্বাসেডর ICT4E, শরীয়তপুর।
সপ্তাহের
সেরা কনটেন্ট নির্মাতা, শিক্ষক বাতায়ন।
মোবাইলঃ
০১৮৩৬৬২৪১৪৮
ইমেইলঃ
[email protected]