তারা জানায়, পুরুষরা যে সম্মান পেতে পারেন, সেই সম্মানটা তারাও পেতে পারে। এখন তারাও তাদের কথা বলতে পারবে। তাদেরও স্বাধীনতা আছে।
মহীরুন নেসা বলে, ‘এই ক্লাস বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়টি আগে থেকে প্রিপায়ার্ড করে দেয়। ওই সময়ে আমরা সবকিছু ঠিকমতো করতে পারি। আমরা আগের চেয়ে এসব বিষয়ে বেশি সচেতন হতে পেরেছি।’
আয়েশা আক্তার অর্নার বক্তব্য, ‘আমরা যা শিখছি অবশ্যই পরিবারের সবাই তা জানে। আমরা এখান থেকে যা শিখছি তারাও শিখছে। আমি যদি জানতে পারি তখন সেই সময়ে সেই অবস্থায় নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারি। এসব জিনিস নিয়ে আমরা কথা বলি, তখন ওদের সঙ্গে কথা হয়।
আনিকা তাবাসসুম বলে, ‘আমরা যা শিখছি তা অভিনয় করে দেখাই। আমরা লুডু খেলি। কম্পিউটারে বিভিন্ন গেম আছে, যেগুলো আমাদের সচেতন করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য বিভিন্ন গেম থাকে। রাস্তায় চলার সময় ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আমরা কীভাবে সামাল দেবো, সেটাও জানতে পারি। আমরা দ্বিধাহীনভাবে বিষয়গুলো মা, ভাই, টিচারদের বলতে পারি। এগুলো আমরা অভিনয় করে নাটকের মাধ্যমে দেখাই। আমরা ক্লাস সিক্স থেকে এই ক্লাস করছি।’
নাফিয়া ফেরদৌস এর সঙ্গে যোগ করে, ‘সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস হয়। আমাদের এই বিষয়ের ওপর একটা পরীক্ষা হয়েছে। স্কুল থেকে ক্রেস্ট এবং সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা অভিনয় করেছি।’
শাহনা আক্তার ইমতিয়াশ বলে, ‘আগে আমরা মনে করতাম ইভটিজিং মেয়েদের কারণেই হয়, এখন আমরা বুঝতে পারছি এটা মেয়েদের কারণে হয় না, ছেলেদের কারণে হয়। আবার আমরা মনে করতাম, মেয়েরা রাস্তায় বের হতে পারবে না, মেয়েদের স্বাধীনতা নেই, মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারবে না। আগে আমরা নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে বৈষম্য করতাম। এখন আমরা মনে করি ছেলেদের মতো মেয়েদেরও সমান অধিকার আছে। যদি একজন নারী দেশ চালাতে পারেন তাহলে আমরাও পারবো।’
আনিকা তাবাসসুম বলে, ‘আমাদের পিরিয়ডের সময় অনেকে কাপড় ব্যবহার করতো। এটা স্বাস্থ্যকর নয়। আগে রাস্তায় আমরা সংকোচে হাঁটতাম। এখন মাথা উঁচু করে হাঁটি।
এই শিক্ষার্থীরা বলে, আগে নারীরা নিজের মতামত জানাতে পারতেন না। বিয়ের পর স্বামীর মত অনুযায়ী চলতেন। কিন্তু এখন স্বামীর মতের সঙ্গে মিলে দুজনে সংসারে কাজ করছেন।
নাফিয়া ও আনিকার ভাষ্য, এখন নারীরা বাইরে কাজ করতে পারেন। পুরুষরাও ঘরে কাজ করতে পারেন। দুজনেই সমান সমান কাজ করতে পারেন। যেমন বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘নারী-পুরুষ একটি গাড়ির দুটি চাকা’, আবার বলেছেন, ‘একটি বৃন্তে দুটি ফুল।’ সমাজের একটি অংশ দুর্বল থাকলে সমাজ খুব বেশি এগোতে পারবে না।
শিক্ষার্থীদের এই ‘বাড়তি’ শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে লুডু খেলা ও কম্পিউটারে গেম খেলা। এর মাধ্যমে মেয়েরা শিখছে তাদের যৌন ও প্রজননশিক্ষা। লুডুর খেলাটির নাম ‘দশ ঊনিশের মোড়’।
এ প্রসঙ্গে ‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু’ প্রকল্পের টেশনিক্যাল অফিসার ইয়াসমিন আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “খেলার শুরুতে ন্যূনতম দুজন থাকতে হবে। ১০ উঠলে খেলা শুরু হবে। যেখানে ‘১’ লেখা আছে সেখান থেকে শুরু হবে। বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন কার্ড আছে। যেমন এই কার্ডটিতে লেখা আছে— ‘ছেলেদের একটি অণ্ডকোষ একটি অন্যটির চেয়ে বড় হতে পারে এবং একটি অন্যটির চেয়ে কিছুটা নিচে অবস্থান করতে পারে— এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই।’ ‘হরমোনের প্রভাবে সাধারণত ১০-১২ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের নানা ধরনের দৈহিক পরিবর্তন দেখা যায়, তবে সে পরিবর্তন কারো ক্ষেত্রে আগে কারো ক্ষেত্রে পরে হতে পারে।’ এই ধরনের লেখাগুলো পয়েন্ট অনুযায়ী পড়তে হবে।”
তিনি বলেন, “এই ম্যাসেজগুলো সবাই খেলতে পারবে। এটা কারো জন্য দোষের কিছু না। অন্য লুডু ‘হার্ডব্রেক’ খেলতে পারে কেবল নবম-দশম শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা।”
স্কুল শিক্ষিকা সেলিনা আখতার বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে এই ক্লাস নিচ্ছি। বিদ্যালয় পর্যায়ে জেন্ডার-সমতা কার্যক্রম বিষয়ক সহায়কের জন্য প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল বইটি মূলত ফলো করি। এখানে জেন্ডার, বাল্যবিয়ে, সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলো আছে। জেন্ডার সমতা কী, ওরা (ছাত্রীরা) আগে বুঝতে পারতো না। সামাজিক বৈষম্যগুলো ধরিয়ে দেওয়া, বাল্যবিয়ে কী— এগুলো নিয়ে ওদের শিক্ষা দিই।’
সেলিনা আখতার বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, ওরা যে মেয়ে না, ওরা মানুষ— সেটা ওদের বোঝানো। ওরা যেন মানুষ হিসেবে নিজেদের ট্রিট করে।’
আরেক শিক্ষিকা মনিদ্বীপা পাল বলেন, ‘এই বিষয়টি এই বছরই পাঠ্যবইতে দেওয়া উচিত ছিল। আমাদের নিয়মিত রুটিনে এই ক্লাস নিই, তাই একটু অসুবিধা হয়।’ তবে শিশুদের এই বিষয়ে প্রবল আগ্রহ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ওরা জানতে চায়, দেখতে চায়। ওরা আসলে একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। ওরা শেয়ার করতে চায়।’
তিনি বলেন, ‘আমি যখনই সুযোগ পাই, শিশুদের বোঝানোর চেষ্টা করি। সিক্সের মেয়েরা ‘ব্যাড টাচ’, ‘গুড টাচ’ বুঝে উঠতে পারে না। এই মেয়েরা না বোঝার আগেই বিপদে পড়ে যায়।’
তবে এই ‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু’ প্রকল্প মেয়াদ শেষে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এতে কিশোর-কিশোরীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।
শিক্ষকরা চাইছেন মূল পাঠ্যবইয়ে এ-সংক্রান্ত দুটি অধ্যায় রাখা হোক। এতে করে সব শিক্ষার্থী এ-সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবে।