Loading..

উদ্ভাবনের গল্প

০৯ মে, ২০২১ ১২:২২ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা কি?


শিক্ষা কী ?

শিক্ষা হল একটি আচরণগত পরিবর্তন । শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শেখার সুবিধা বা জ্ঞান , দক্ষতা , মান , বিশ্বাস এবং অভ্যাস অর্জন করা যায়। কারও মতে শিক্ষা হচ্ছে বৃদ্ধি ও বিকাশমূলক প্রক্রিয়া, আবার কেউ বলেন শিক্ষা সামাজিক প্রক্রিয়া, শিক্ষা জীবন যাপনের প্রস্তুতি।

শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি :-

বাংলা ‘শিক্ষা‘ শব্দটি সংস্কৃত ধাতু শাস থেকে এসেছে । যার অর্থ হল শাসন করা । শিক্ষা শব্দটির সমার্থক শব্দ ‘বিদ্যা’ সংস্কৃত ধাতু বিদ থেকে এসেছে , যার অর্থ হল ‘জানা’ বা ‘জ্ঞান’ অর্জন করা । শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education শব্দটির উৎস কয়েকটি ল্যাটিন শব্দ থেকে । কারো মতে শব্দটি ল্যাটিন Educere থেকে উদ্ভূত , যার ইংরেজি অর্থ হচ্ছে To lead out অর্থাৎ শিশু এবং শিক্ষার্থীর মনের মধ্যে যে সব মানসিক শক্তি জন্মসূত্রে বিদ্যমান সেগুলিকে বাইরে আনা ।

দ্বিতীয় মত অনুযায়ী – Education শব্দটির মূল ল্যাটিন শব্দ Educare থেকে উদ্ভূত যার অর্থ হল To bring up – অর্থাৎ প্রতিপালন করা বা পরিচর্যা কর । এই অর্থে শিক্ষা হচ্ছে , কতগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ সামনে রেখে শিশুকে সঠিকভাবে লালন-পালন করার প্রক্রিয়া।

তৃতীয় মত অনুযায়ী – Education ইংরেজি শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Educatum থেকে এসেছে, যার অর্থ হল- The act of training । এই মতানুযায়ী শিক্ষার অর্থ হচ্ছে শিশু বা শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবন উপযোগী কিছু কৌশল আয়ত্ত করার প্রশিক্ষণ দেওয়া ।

Joseph Twadell Shipley তাঁর Dictionary of word origins এ লিখেছেন Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Edex এবং Duccrduc শব্দগুলো থেকে। যার শাব্দিক অর্থ হল যথাক্রমে বের করা ,পথ প্রদর্শন করা । আর একটু ব্যাপক অর্থে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করা ।

শিক্ষার সংজ্ঞা :-

প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাবিদদের ধারণায় শিক্ষা :-

উপনিষদে বলা হয়েছে – শিক্ষা মানুষকে সংস্কারমুক্ত করে তোলে
ঋগবেদে বলা হয়েছে – শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মত্যাগী করে তোলে।
কৌটিল্যের মতে – শিক্ষা হল শিশুকে দেশ বা জাতিকে ভালোবাসার প্রশিক্ষণ দেওয়ার কৌশল।
শঙ্করাচার্যের মতে – আত্মজ্ঞান লাভই হল শিক্ষা।

আধুনিক ভারতীয় শিক্ষাবিদগণের মতানুযায়ী শিক্ষা :-

তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না , যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ব্যক্তির দেহ , মন ও আত্মার সুষম বিকাশের প্রয়াস । – গান্ধিজী

মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশই হল শিক্ষা । – স্বামী বিবেকানন্দ ।

মানুষ যে বিকাশমান আত্মসত্তার অধিকারী তাকে সম্পূর্ণভাবে বিকাশ করার যে প্রচেষ্টা তাই হল শিক্ষা। – ঋষি অরবিন্দ।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদগণের মতানুযায়ী শিক্ষা :-

শিক্ষার্থীদের দেহ মনের বিকাশ সাধন এবং তার মাধ্যমে জীবনের মাধুর্য ও সত্য উপলব্ধিকরণ। — অ্যারিস্টটল।

শিক্ষা হল শিশুর স্বতস্ফুর্ত আত্মবিকাশ , যা মানব সমাজে সকল কৃত্রিমতা বর্জিত একজন স্বাভাবিক মানুষ তৈরীতে সহায়ক। — রুশো।

শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার অবিরত পুনর্গঠনের মাধ্যমে জীবন-যাপনের প্রক্রিয়া। — জন ডিউই।

শিক্ষা হল শিশুর নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী দেহ মনের সার্বিক বিকাশের সহায়ক প্রক্রিয়া। — প্লেটো।

শিক্ষা হল অন্তর্নিহিত সুপ্ত সম্ভাবনার উন্মেষ সাধন । — ফ্রয়বেল।

শিক্ষার ধারণা :-

শিক্ষার অর্থ বিশ্লেষণ করলে তার দুটো অর্থ দেখতে পাওয়া যায় , একটি হল সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা , অপরটি হল ব্যাপক অর্থে শিক্ষা।সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে বোঝায় কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমকে সামনে রেখে শিক্ষিত ও অভিজাত ব্যক্তি দ্বারা পাঠ্যক্রমের বিষয়গুলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চালন করা । 

সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হল –

১. জ্ঞান বৃদ্ধি করা , ডিগ্রীলাভ করা।
২. এটি একটি একমুখী প্রক্রিয়া ।
৩. বিদ্যালয়কেন্দ্রিক এবং পুথিনির্ভর। ৪. অপরিবর্তন ও গতিহীন প্রক্রিয়া।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষা :-

শিক্ষাবিদদের মতে ব্যাপক অর্থে শিক্ষার তাৎপর্য হল শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ সাধন করা।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হল –


১. এটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া
২. ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল দ্বিমুখী প্রক্রিয়া ।
৩. এটি জীবনব্যাপী ক্রমবিকাশ প্রক্রিয়া । এই শিক্ষা শিশুর জন্মগত সামর্থ্য , অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও স্বতঃস্ফুর্ত চিন্তাশক্তি ক্রমবিকাশে সাহায্য করে ।
৪. এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও প্রবণতা অনুযায়ী হয়ে থাকে ।
৫. এই শিক্ষা আচরণের পরিবর্তন , মূল্যবোধের বিকাশ , উদারনৈতিক মনোভাব গঠনে সহায়তা করে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য :-

অ্যারিস্টটলের মতে – “শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।”

সক্রেটিস এর মতে – “শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।

প্লেটোর মতে – শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন , তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যে অন্তর্ভূক্ত ।

বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বাট বলেছেন – শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভাবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ।

জন ডিউই এর মতে – শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্ম উপলব্ধি ।

রুশো এর মতে – সু-অভ্যাস গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য ।

কিন্ডার গার্ডেন পদ্ধতির উদ্ভাবক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্ ফ্রয়বেলের মতে – শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য ও পবিত্র জীবনের উপলব্ধি ।

পার্সীনান বলেছেন – শিক্ষার উদ্দেশ্য হল চরিত্র গঠন , পরিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রস্তুতি এবং ভালো দেহ ভালো মন গড়ে তোলা ।

পার্কার বলেছেন – পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্মপ্রকাশের জন্য যে সব গুণাবলী নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে , শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সে সব গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন।

কমেনিয়াস এর মতে – শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত । আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা ।

জেনে রাখুন : কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ানোর ১০টি উপায়

শিক্ষার লক্ষ্য :-

জন ডিউই (John Dewey) এর মতে – Aim is a foreseen end which gives direction to a certain activity or motivates human behaviour. অর্থাৎ লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ব দৃষ্ট বাঞ্ছিত উদ্দেশ্য যা আমাদের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে অথবা আচরণকে উদ্দীপ্ত করে ।

প্রত্যেক সচেতন প্রচেষ্টার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য থাকে। যেহেতু শিক্ষা সচেতন প্রচেষ্টা অতয়েব শিক্ষারও লক্ষ্য থাকা স্বাভাবিক।

Encyclopedia of Modern Education গ্রন্থে বলা হয়েছে – শিক্ষা হল উদ্দেশ্যমূলক নৈতিক কাজ । অতএব লক্ষ্যহীন শিক্ষা চিন্তাই করা যায় না । (Education is purposeful and ethical activity. Hence it is unthinkable without aims.)


শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে শিশুদের বিকাশকে কার্যকরী ও ত্বরান্বিত করে তাদের পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা , যাতে করে তারা তাদের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে উন্নততর ও সার্থক সংগতি বিধান ও অভিযোজন করতে পারে ।

অ্যারিস্টটলের ভাষায় – “Every art does something good, Education is an art. It is to be seen what good is done by Education to man and society.

শিক্ষা একটি পরিবর্তনশীল নিরবচ্ছিন্ন গতিশীল সচেতন সামাজিক প্রক্রিয়া । তাই শিক্ষার লক্ষ্য যুগে যুগে দেশে দেশে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ্দের দ্বারা বিভিন্ন শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী বিভিন্নভাবে ব্যাঘাত করেছে ।

প্রাচীন ভারতে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল আত্মজ্ঞান বা আত্মউপলব্ধি । কিন্তু আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটিয়ে উপযোগী সুনাগরিক রূপে গড়ে তোলা ।

বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাবিদ্ ও দার্শনিকের ধারণা অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্যগুলি হল –

(ক) শিক্ষার লক্ষ্য জ্ঞানার্জন করা :-

কোন কোন শিক্ষাবিদের মতে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীকে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করা । যেমন সক্রেটিস বলেছেন – Knowledge is power by which things are done.

(খ) নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা :-

শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুর নৈতিক চেতনা জাগ্রত করা । শিক্ষা শিশুর মধ্যে নৈতিক চরিত্র গঠনে সাহায্য করবে । Herbert বলেছেন – A handful of good life is worth a bushel of learning. অর্থাৎ অনেক বেশি শিক্ষার থেকে কয়েকটি সৎ জীবন অনেক শ্রেয়।

(গ) কৃষ্টি চেতনার উন্মেষ ঘটানো :-

শিক্ষার লক্ষ্য হল সমাজের অতীত কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে পরিচিত করা । এক কথায় নিজস্ব সাংস্কৃতিক সত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটানো ।

(ঘ) চরিত্র গঠন করা :-

শিক্ষাবিদ্দের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুর চরিত্র গঠন করা । গান্ধিজী বলেছেন – চরিত্র গঠনই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন – চরিত্রকে বলিষ্ঠ ও কর্মঠ করাই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য 

(ঙ) আধ্যাত্মিক চেতনাকে জাগ্রত করা :-

অনেক দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ্গণ আধ্যাত্মিক জীবনের বিকাশ ও উন্নত ধরণের জীবনাদর্শন বিকাশের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন –

ঋষি অরবিন্দ বলেছেন – শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত বিকাশমান আত্মার অন্তর্নিহিত সত্তাকে জাগ্রত করে মহৎ উদ্দেশ্য ত্রুটিমুক্ত করা বা নিখুঁত করে তোলা ।
ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রাধাকৃষ্ণন বলেছেন –

The aim of education is neither national efficiency nor world solidarity, but making the individual feel that he has within himself something deeper than intellect, call it spirit, if you like.

অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য জাতীয় কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি নয় বা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা নয়, শিক্ষার লক্ষ্য হবে বরং ব্যক্তির অন্তরে এমন এক চেতনার উন্মেষ ঘটানো যা বুদ্ধি অগম্য যাকে আধ্যাত্মিকতা বলে চিহ্নিত করতে পারো ।

(চ) সুনাগরিক গড়ে তোলা :-

শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুকে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা, যাতে নিজেকে প্রকাশিত করার সমস্ত গুণাবলী তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে ।

(ছ) বৃত্তিশিক্ষা বা হাতে কলমে শিক্ষা :-

শিক্ষার লক্ষ্য এমন হওয়া উচিত যা জীবিকা উপার্জনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এক কথায় যাকে বলা হয় বৃত্তিশিক্ষা। বৃত্তিশিক্ষা জীবনে স্বাচ্ছন্দ আনার হাতিয়ার । জন ডিউই এর মতে – ব্যক্তি কী করতে পারে তা নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী বৃত্তি নির্বাচন করলে এবং কাজে নিযুক্ত করলে সে সুখী হয়। বুদ্ধির দিক থেকে যারা দুর্বল তারা বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে।

এছাড়া শিক্ষার বাকি লক্ষ্যগুলি হল –

১. শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল সমাজের আচরণগত , রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলিকে নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা ।
২. প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটানো ।
৩. শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল বিভিন্ন পরিবেশের সাথে যাতে শিশু সার্থক সংগতি বিধান করে চলতে পারে। 
৪. গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি সাম্যবাদ, শ্রেণী বৈষম্য-হীন সমাজ , সহযোগিতাবোধ ও ভ্ৰাতৃত্ববোধের।