সৌপ্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা: ভারতে প্রথম এক্সরে মেশিন নিজ হাতেই তৈরি করেছিলেন তিনি। রেডিওর আবিষ্কর্তা তিনিই। তিনিই প্রথম বলেছিলেন উদ্ভিদের প্রাণ রয়েছে। সবার আগে বারবার বিজ্ঞানের বড় আবিস্কার এবং তত্বগুলি আনলেন ভারত তথা বিশ্ববাসীর সামনে। কিন্তু কেবল মাত্র ভারতীয় বলেই হয়তো যোগ্য সম্মানটি পাননি জগদীশ চন্দ্র বসু। আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার বাঙালি বিজ্ঞানী বারবার তার দুঃখের কথা প্রকাশ করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়।

প্রথমে এক্সরে’র কথাতেই আশা যাক। ১৮৯৫ সালে এক্সরে বা রঞ্জন রশ্মি আবিস্কার হয় । ভারতে তা এসে পৌঁছতে আরও কিছু বছর সময় লাগে। কিন্তু তার আগেই স্যর জগদীশ চন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরিতে এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে থাকেন । তার উল্লেখ পাই তাঁরই লেখা এক চিঠির মাধ্যমে।

১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লিখেছেন, “যদি পারেন তাহা হইলে সকাল আটটার সময়ে প্রেসিডেন্সী কলেজ হইয়া আসিবেন । রঞ্জন কলে একজন রোগী দেখিতে হইবে , তাহার পৃষ্ঠভঙ্গ হইয়াছে । ডাক্তার নীলরতন সরকারের কথা এড়াইতে পারিলাম না।” ১৯শতকের শেষের দিকের ভারত তখন ভরা পরাধীনতার জ্বালায়। কেউ জানতই না প্রেসিডেন্সির ল্যাবটরিতে বসে মানুষটি কি কাণ্ডটাই না ঘটাচ্ছিলেন।

আশা যাক রেডিওর কথায়। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছাড়া একে আর কিই বা বলা যেতে পারে। অনেকটা সত্যজিত রায়ের চিত্রনাট্যের হুবহু নকল করে বানানো স্পিলবার্গের ছবি ইটি’র মতো। লিখলেন সত্যজিত, বলা হয় চুরি করে নাম কিনলেন স্পিলবার্গ। ছোট থেকে আমাদের বিজ্ঞান বইতে বড় বড় করে লেখা থাকে রেডিও আবিষ্কারক হিসাবে মার্কনি। কিন্তু এই যন্ত্রের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন তিনি।

আচার্য বসু নিজের সৃষ্ট অণুতরঙ্গ ভিত্তিক বেতার সংকেত প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন মার্কারি কোহেরার। যন্ত্রটি কলকাতাতে বসেই তিনি নির্মাণ করেন। যন্ত্রটিতে যে প্রযুক্তিবিদ্যা ব্যবহার করেছিলেন তার নাম সলিড স্টেট ডায়োড। ১৮৯৯ সালের বিভিন্ন সময়ে এই কোহেরার যন্ত্রটি প্রদর্শিত হয়েছিল। জগদীশচন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি ১৮৯৯-১৯০১ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোথাও ছিল না । সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সলিড স্টেট ডায়োড ডিটেক্টর এবং মাইক্রোওয়েভ প্রজাত অদৃশ্য আলোর জনক হলেন স্যর জগদীশচন্দ্র বসু।

১৯০১ সালে মার্কনি যে ডায়োড ডিটেক্টর যন্ত্র দিয়ে আটলান্টিকের এপার থেকে ওপার,অর্থাৎ ইউরোপ থেকে আমেরিকাতে বেতার সংকেত পাঠিয়েছিলেন তা ১৮৯৭ সালে লন্ডন রয়্যাল সোসাইটিতে প্রদর্শিত জগদীশচন্দ্রের নির্মিত যন্ত্রের প্রযুক্তির হুবহু নকল।

কিন্তু কিভাবে এই ঐতিহাসিক চক্রান্তটি হল। আসলে মার্কনির ছেলেবেলার বন্ধু লুইগি সোলারি তখন ইতালির নৌবাহিনীতে কাজ করছিলেন। তিনিই এই মার্কারি কোহেরার যন্ত্র ও টেলিফোন গ্রাহক যন্ত্রের নির্মাণ ও ব্যবহার পদ্ধতি মার্কনির গোচরে আনেনl

শুধু তাই নয় তিনিই প্রকৃতপক্ষে জগদীশচন্দ্রের সমগ্র প্রযুক্তির হুবহু নকল করে একটি যন্ত্র নির্মাণ করে ইংল্যান্ডে্ এসে মার্কনিকে উপহার দেন। সেটাকেই মার্কনি নিজের নামে চালিয়ে দিলেন। বন্ধুর প্রতিও তিনি কৃতঘ্নের মতোই আচরন করেন।

১৯০১, ১২ ডিসেম্বর দুপুরে মার্কনি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে একটা ধাতব তার ৪০০ ফুট ঊর্ধ আকাশে তুললেন এবং আয়রন মার্কারি আয়রন কোহেরার উইথ টেলিফোন গ্রাহক যন্ত্রের সাহায্যে স্পষ্ট শুনতে পেলেন ইংলন্ড থেকে আটলান্টিক অতিক্রম করে ভেসে আসা পুনঃপুনঃ বেতার তরঙ্গ সংকেত টক্ টক্ টক্ টক্ শব্দ। তখন বেলা সাড়ে বারোটা,টেলিফোনটা দিলেন তাঁর সঙ্গী জর্জ স্টিফেনকে। তিনিও স্পষ্ট শুনলেন সেই শব্দ।

খবরের কাগজ ও টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল মার্কনির বিজয় গৌরব। ১৯০৯ সালে মার্কনিকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হল। আর বাঙালি বিজ্ঞানী বেতার তরঙ্গের সৃষ্টির আবিষ্কারক হিসাবে অজ্ঞাত থেকে গেলেন।

তাঁর লেখা ‘অব্যক্ত ‘গ্রন্থে এই কষ্টের কথা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছিলেন “যাঁহারা আমার বিরুদ্ধ পক্ষে ছিলেন তাঁহাদেরই মধ্যে একজন আমার আবিষ্কার নিজের বলিয়া প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন ফলে বহু বৎসর যাবৎ আমার সমুদয় কার্য পন্ডপ্রায় হইয়াছিল। এ সকল স্মৃতি অতিশয় ক্লেশকর।”

১০৯ বছর আগে পরাধীন দেশের অশ্বেতাঙ্গ বিজ্ঞানীর পক্ষে বেতার যন্ত্রের উদ্ভাবকের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়নি বটে তবে তিনি বিশ্বকে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তা নিয়েও প্রথমে কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে। অনেক লড়াইয়ের পর এই আবিষ্কারটা তাঁর থেকে আর কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি।

তথ্য : ডঃ প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডাঃ স্বপন কুমার গোস্বামী