Loading..

পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি/ইমেজ

১০ মে, ২০২১ ১০:৫৯ অপরাহ্ণ

শৈশবকালের স্মৃতি ---------------------
শৈশবকালের স্মৃতি
একসময় যখন শহরেই অনেকের বাসায় বিদ্যুৎ ছিলোনা গ্রামে বিদ্যুতের কথাতো চিন্তায়ও আসতো না। তবুও তখন বিদ্যুৎবিহীন গ্রামের বাড়ীতে আমাদের কৈশোরকালের দিনগুলো স্বচ্ছন্দেই কেটেছে। আলোর অভাব বোধ করিনি কখনো। মানিয়ে চলেছি সবকিছুতে। বিদ্যুৎ নাই তাতে কি! জীবন থেমে ছিলোনা। ওইটাই ছিলো আমাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন।
সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঘরে হারিকেন বা কুপি বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হতো।কেরোসিন তেল মজুত থাকতো ঘরে। তবুও কখনো হঠাৎ মজুদ শেষ হয়ে গেলে দোকান থেকে বোতলে ভরে কেরোসিন নিয়ে আসতাম এক দৌড়ে। তেলের বোতলের গলায় চিকন দড়ির বরশি গেঁড়ো দিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা ছিলো। কেরোসিনের বোতলে হাত লাগলে হাত গন্ধ হয়ে যেতো। সরিষার তেল মেখে সে গন্ধ দূর করতে হতো।
সন্ধ্যার আগেই হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার, কুপি বাতির সলতে ঠিক করা, তাতে তেল ভরা ছিলো প্রাত্যহিক জীবনের কাজ। আমার পড়ার জন্য নির্ধারিত হারিকেন পরিষ্কার করার কাজটি আমি নিজের হাতেই করতাম। পুরনো কাপড়ের তেনা দিয়ে কখনো বা সাবান দিয়ে ধুয়েমুছে চিমনি পরিষ্কার করে নিতাম। চিমনি যত পরিষ্কার আলো তত উজ্জ্বল হবে। চিমনি বেশি পরিষ্কার করতে যেয়ে অনেক সময় ভেঙে ফেলেছি আবার হাতও কেটেছি। আবার ভাঙা চিমনি চিকন তার দিয়ে বেঁধে কাজ চালিয়েছি।
বসতঘরে বাবা-মা থাকতেন তাই বাড়ীর আলগা ঘরে ছিলো আমার পড়ার ব্যবস্থা। পড়ার টেবিলের পাশে নিজের হাতে ঘরের বেড়া কেটে খিড়কি বানিয়ে নিয়েছিলাম। কিশোরমন হলেও পড়ার টেবিলে বসে বাহিরে কিছু দেখার বাসনা থেকেই হয়তো এমনটি করেছিলাম।
পড়ার টেবিলের মাঝখানে হারিকেন রেখে আমার চাচাত ভাই আর আমি দুইজন দুইপাশে বসে পড়তাম। একজনের পড়ার শব্দে আরেকজনের ডিস্টার্ব হলেও তেমন সমস্যা হতোনা। মানিয়ে নিতাম। এখনকার মতো সবার জন্য পৃথক পৃথক পড়ার ঘর বা পৃথক পৃথক টেবিল লাগতো না। হারিকেনের চিমনিতে এক টুকরো কাগজ গুঁজে নিতাম তাতে আলো সরাসরি চোখে পড়তো না, এক ধরনের স্বাচ্ছন্দতা লাগতো।
কখনো হারিকেনের তেল ফুরিয়ে গেলে কুপি বাতি জ্বালিয়েও পড়তে হয়েছে। সেটা প্রাইমারি লাইফের কথা। কুপি বাতি দিয়ে পড়া নিষেধ ছিলো। কুপি বাতির লম্বা শিষের কালি নাকে ঢুকা মানে খুবই অস্বাস্থ্যকর। দীর্ঘক্ষণ কুপি বাতি জ্বালিয়ে পড়লে নাকে আঙুল দিলে কালো ময়লা আঙুলে লাগতো। ক্লাসের পড়া মুখস্ত করার দায় সারতে কুপি বাতির কালির কোন রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়ার চিন্তা মাথায় আসতোনা কখনো।
আমরা দুই ভাই সকালে যখন স্কুলে যেতাম তখন বাম গালে রোদের তাপ লাগতো আবার বিকেল বেলা ফিরার পথেও একই ঘটনা ঘটত। একদিন বারির দেউরির সামনে দাদু, ছোট ফুফু আর মা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল কখন বারি ফিরব। সেই দিনগুলোর কথা অবসর সময়ে খুবই মনে পরে।
কিশোরকালে খেলাধুলা ঘুড়ি উড়ানো ডানপিটেমি যাই করিনা কেন সন্ধ্যায় পড়ার ঘরে অবশ্যই বসতে হতো। টায়ারের ফিতে যুক্ত কাঠের চটি বা 'খরম' পায়ে বাড়ির কুয়া থেকে পানি তুলে হাত পা ধুয়ে এসে পড়ার টেবিলে বসতাম।
গৃহস্থবাড়ি তাই পাটের আবাদ হতো খুব। বর্ষায় ভেজা পাটের গন্ধে মশার উপদ্রব বেড়ে যেতো।মশার উপদ্রপে পড়তে সমস্যা হতো খুব। মশা তাড়ানির জন্য তখন ছিলোনা মশার কয়েল বা কোন ক্যামিক্যাল। তবে মশা তাড়ানোর জন্য ছিলো অভিনব কিছু কৌশল। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় গোয়ালঘরের দরজার মুখে খড়কুটো দিয়ে বড় একটা সাঁজাল দেয়া হতো। সাঁজালে আগুন ধরিয়ে ভাঙা কুলো বা সুপারির খোল দিয়ে জোরে বাতাস করা হতো এবং প্রচন্ড ধোঁয়ায় পুরোবাড়ি ছেয়ে যেয়ে মশককুল সাময়িক দূর হয়ে যেতো।
পড়ার ঘরে সাঁজাল দেয়া সম্ভব ছিলোনা আগুন লাগার ভয়ে। তাই বিকল্প হিসাবে পাটশোলার আঁটি বেধে তাতে আগুন ধরিয়ে ঘরে রেখে দিলে মশা দূর হয়ে যেতো। পাটশোলার আঁটিতে কিছুক্ষণ পরপর পানি ছিটিয়ে দেয়া হতো এবং তা অনেকক্ষণ লাস্টিং করতো। শুধু পাটশোলা কেন, ধানের খেড় (খড়) দিয়ে বেণী বানিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখলেও মশা দূর হত।
বৈশাখ জৈষ্ঠ্যমাসের গরমের তীব্রতাও মানিয়ে নিয়েছি স্বাচ্ছন্দ্যে। ঘরে তৈরি হাত পাখাই ছিলো দুঃসহ গরম থেকে নিস্তার লাভের একমাত্র উপায়। সুপারি গাছের খোল কেটে বাঁশের কাটি আর চিকন নলি সহযোগে হাতপাখা তৈরি করা হতো। বাঁশের চিকন বেতি তুলে বুনন করা হতো নক্সী হাত পাখা। নিপুন হাতে বিভিন্ন নক্সা ফুটিয়ে তোলা হতো হাত পাখায়। এটাকে বলা হতো চিকন কাজ। সাধারণত মহিলারাই করতেন এই হাতপাখা বুনন কাজ। কুমারী বয়স থেকেই এই চিকন কাজ আয়ত্ত করে নিতো।
কাপড় দিয়েও তৈরি করা হতো হাত পাখা। সাদা টুকরো কাপড়ে সুঁই-সুতোর ফোঁড়ে ফোঁড়ে বিভিন্ন ফুল পাখি চিত্রিত করা হতো। গোল করে কাপড় কেটে বাঁশের ফ্রেমের নক্সী বর্ডার দেয়া হতো। গ্রামের কুমারী মেয়েদের ভালোবাসার গোপন আকুতি স্বরূপ কাউকে উদ্দেশ্য করে বানানো হলে তাতে মুখোমুখি একজোড়া পাখির প্রতিকৃতি এঁকে লিখা থাকতো- 'যাও পাখি বলো তারে সেযেন ভুলেনা মোরে'। নিজেকে নিবেদনের জন্য আরো কতকিছুই লেখা থাকতো সেই হাত পাখায়! এখন সেই সূচিকর্ম নেই। গ্রামেও ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। মনের গোপন আবেগ ভালোবাসা বিনিময় হয় এখন এসএমএস বা মোবাইল চ্যাটিং এ।
সেই কবে থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য গ্রাম ছাড়ার পর শুরু হয় আরেক জীবন। চিরকালের জন্য কেটে যাচ্ছে গ্রামের সাথে গেঁথে থাকা সেই অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, দিনে দিনে শিথিল হয়ে যাবে নাড়ির টান, তা কি কখনো ভেবেছিলাম! অাধুনিক শিক্ষা আর নগর সভ্যতার টানে মেঠোপথ ছেড়ে সেই যে গ্রামছাড়া হলাম তা আজো অব্যাহত আছে। কোথায় কখন যেয়ে শেষ হবে এই পথচলা তাও জানিনা।
মা একদিন আমাকে চৌকির পায়ার সাথে দরি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল সন্ধ্যার পরে ঘরে ফিরার কারণে সেইদিনের কথা আজও মনে পরে।
সংগৃহিত ।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি