Loading..

ম্যাগাজিন

১৩ মে, ২০২১ ০৪:৪১ অপরাহ্ণ

দেশপ্রেমিক দুই সাহসী নারী…; মোছাঃ মারুফা বেগম, প্রধান শিক্ষক, ডিমলা, নীলফামারী।

 

 

দেশপ্রেমিক দুই সাহসী নারী

মাতৃভূমির জন্য যে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছিল, তার ইতিহাস হচ্ছে গভীর আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস, বিশাল এক অর্জনের ইতিহাস। আর এ ইতিহাস সৃষ্টিতে প্রাণ দিতে হয়েছে ত্রিশ লাখ মানুষকে। সম্মান হারাতে হয়েছে দুই লাখ মা-বোনকে। নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন স্বাধীনতাযুদ্ধে। তারা আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। জুগিয়েছেন খাদ্য, বহন করেছেন অস্ত্র, গোপন সংবাদ আনা-নেওয়া করেছেন। হাজার হাজার নাম না জানা নারী আছেন যারা নিজের সব স্বার্থ ত্যাগ করে, সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে দেশমাতার জন্য স্বামী, সন্তানকে দাঁড় করিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সারিতে।

কাঁকন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরাসহ হাজারো নাম না জানা নারী আছেন, যারা অবদান রেখেছেন স্বাধীনতাযুদ্ধে। পুরুষদের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন এমন অনেক নারী। তাদের এই অবদানের জন্য আজকের এই বাংলাদেশ। আজ বলছি স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন এমন দুজন সাহসী নারীর কথা-

 

তারামন বিবি

তারামন বিবি নামে পরিচিত এই নারীর নাম তারামন বেগম। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সম্মুখ সমরে অস্ত্র হাতে লড়েছেন তিনি। বীরত্বের জন্য ১৯৭৩ সালে পেয়েছেন বীর প্রতীক খেতাব। বাংলাদেশের খেতাবপ্রাপ্ত দুজন নারী বীর প্রতীকের একজন তারামন বিবি। একাত্তরে দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তখন তিনি অনেক ছোট। বয়স হবে ১৪-১৫। ছোট থাকতেই বাবা মারা যান। মা তখনো বেঁচে ছিলেন। সাত ভাই-বোনকে নিয়ে কষ্টের সংসার ছিল তাদের। তখন সময়টা ছিল চৈত্র মাস। দেশে তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর। আতঙ্ক চারদিকে।

কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর ইউনিয়নে বাস করতেন তারামন বিবি ও তার পরিবার। যুদ্ধের সময় যখন মানুষ এক জায়গা থেকে পালিয়ে আরেক জায়গাতে যাচ্ছে, তখন তারাও একদিন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে পাশের ইউনিয়ন কোদালকাঠিতে আশ্রয় নেয়। সেখানে ছিল বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা তাদের মতো অনেক মানুষ। সবাই উপোস। নেই কারো জন্য খাবার। এমনই এক সময় তারামন বিবিকে মুক্তিযোদ্ধারের জন্য রান্নার প্রস্তাব দেয় হাবিলদার নামের এক ব্যক্তি।

তারামন বিবির মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে মুহিব হাবিলদার ধর্ম মেয়ে করে নেন তাকে। এ ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়তা করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আজিজ মাস্টার। এরপর তারামন বিবি চলে যায় কোদালকাঠির দশঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে রান্না করা, ডেক ধোয়া আর অস্ত্র পরিষ্কার করার কাজ শুরু করেন। এটি ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি যুদ্ধ ক্যাম্প। শুরু হয় তার যুদ্ধের জীবন।

তার ধর্ম বাবা মুহিব হাবিলদারই তাকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। রাইফেল চালানো কিছুটা কষ্টের হওয়ায় স্টেনগান চালানোর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নিতে শুরু করেন প্রতিটি অপারেশনে। সফল হন যুদ্ধক্ষেত্রে।

গোয়েন্দা তথ্য আনতে বেরোলে মাথায় গোবর লাগিয়ে, মুখে কালি দিয়ে উপুড় হয়ে গড়াতে গড়াতে শত্রুর কাছাকাছি চলে যেতেন তারামন বিবি। কোথায় শুত্রুর অস্ত্র আছে, কোথায় অপারেশন চালাতে হবে, এসব তথ্য এনে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তারপর শুরু করতেন পরিকল্পনামাফিক অপারেশন।

বর্তমানে তারামন বিবি তার স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে কুড়িগ্রামের রাজীবপুরেই আছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সিতারা বেগম

আমাদের মায়েরা দোলনা দুলিয়ে যেমন সন্তানকে অমিয় সুধা পান করাতে পারে, তেমনি অস্ত্র হাতে মা মাতৃভূমিকে রক্ষাও করতে জানে, তা যেন প্রমাণ করে দেন সিতারা বেগম। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বীর প্রতীক প্রাপ্ত আরেকজন নারী হলেন এই সিতারা বেগম।

১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্ম সিতারা বেগমের। তার বাবা মো. ইসরাইল মিয়া ছিলেন একজন আইনজীবী। বৈবাহিক সূত্রে তিনি সিতারা রহমান নামে পরিচিত। কিশোরগঞ্জে সিতারা বেগম শৈশব কাটান। সেখান থেকে মেট্রিক পাস করার পর হলিক্রস কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে (ঢামেক) ভর্তি হন। ঢামেক থেকে পাস করার পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনা মেডিক্যালে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন।

১৯৭০ সালে সিতারা বেগম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময় তার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজর এ টি এম হায়দার পাকিস্তান থেকে কুমিল্লায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি কুমিল্লার তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিতারা ও তার ভাই হায়দার ঈদের ছুটিতে কিশোরগঞ্জের বাড়িতে যান। কিন্তু সেই সময়ে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। হায়দার তার বোনকে ক্যান্টনমেন্টে আর ফিরে না যাওয়ার জন্য বলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার বোন সিতারা, বাবা-মা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতে পাঠান।

স্বাধীনতাযুদ্ধে আহত বা অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে ২ নম্বর সেক্টরে এমন একটি হাসপাতাল ছিল। যা প্রথমে স্থাপিত হয় সীমান্তসংলগ্ন ভারতের সোনামুড়ায়। পরে স্থানান্তর করা হয় আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে। জুলাই মাসে ডা. সিতারা বেগম বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেন। পরে হাসপাতালের সিও (কমান্ডিং অফিসার) কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ওই হাসপাতালে পাঠানো হতো। যাদের কেউ শেলের স্প্লিন্টারে আঘাতপ্রাপ্ত, কেউ গুলিবিদ্ধ। ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামের স্বল্পতা সত্ত্বেও সেবার কোনো ত্রুটি ছিল না। আর এ ক্ষেত্রে সিতারা বেগম তার মেধা, শ্রম ও দক্ষতা দিয়ে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বিশেষ অবদান রাখেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিতারা বেগম রেডিওতে বাংলাদেশের বিজয়ের সংবাদ শুনে ঢাকা আসেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে তার ভাই মেজর হায়দার খুন হলে ডা. সিতারা ও তার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও তিনি বিশেষ অবদান রাখেন স্বাধীনতাযুদ্ধে। এ অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার সিতারা বেগমকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে।

(সংগ্রৃহীত)

 

 

 

মোছাঃ মারুফা বেগম (এম এ, এম এড)

প্রধান শিক্ষক 

খগা বড়বাড়ী বালিকা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়

ডিমলা, নীলফামারী।

 ICT4E জেলা অ্যাম্বাসেডর, নীলফামারী

ও সেরা কনটেন্ট নির্মাতা, a2i.gov.bd

Email ID: lizamoni355@gmail.com

 

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি