শিক্ষক বাতায়ন আমাকে আলোকিত করেছে
আমি শাহানারা আক্তার হ্যাপি, সহকারী শিক্ষক, কালিয়াপাড়া ডাকাতিয়া মাজেদা মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়, সখিপুর, টাঙ্গাইল। এইচএসসি পরীক্ষার দু’মাস আগে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর পড়ালেখা করাটা কিছুটা কঠিনই ছিল। তখন শ্বশুড়বাড়ির অনেকেই চাচ্ছিল না আমি আর পড়ালেখা করি, কিন্তু আমার মনের অদম্য ইচ্ছা ছিল, লালিত স্বপ্নটাকে বাস্তবায়িত করতে। ধীরে ধীরে পরিবারের সকলের মন জয় করার চেষ্টা করি, আমার শ্বাশুড়ি-মা আমাকে সাহায্য করেন, যা-হোক পরীক্ষা দিলাম এবং পাশ করলাম ! স্বপ্নটা বড়ো হতে লাগলো, এরই মাঝে এক বছর পর আমার কোল আলো করে এলো আমার প্রথম সন্তান। সন্তান আর পরিবার সামলাতে গিয়ে এইচএসসি’র পর পড়াশোনার জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে গেলো কিন্তু হাল ছাড়িনি। ঠিক এভাবেই আমার পড়ালেখার জীবন শেষ হয়। আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত তাই, আমি সকল কাজে উৎসাহ পেয়েছিলাম। আমার বাবা ছিলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, আর মা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
আলহামদুল্লিলাহ আমি
শিক্ষকতা নামক মহান পেশায় যোগদান করি ২০০১ সালে। আমার স্কুলটা গ্রামের ভেতরে,
প্রত্যন্ত এলাকা বলা যায়, যেখানে ২৪ ঘন্টার মাধ্যে মাত্র ৬/৭ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে।
২০১৪ সালের দিকে, তখন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে কম্পিউটার বিষয়ক ICT ট্রেনিং হচ্ছিল, প্রধান শিক্ষক আমাকে ট্রেনিং এ অংশগ্রহণ করতে বলেন, ICT ট্রেনিং আমি শুনেই ভয়ে শেষ ! কারণ আমি এর আগে কখনও ল্যাপটপ ধরিনি এবং ল্যাপটপের কিছুই বুঝি না। বলতে গেলে, এক প্রকার জোড় করেই আমাকে ট্রেনিং করতে পাঠানো হয়। আমি আতঙ্কিত ছিলাম এজন্যই, ‘যে আমি মাউস ধরতে পারিনা সে আমি কীভাবে ট্রেনিং করবো’ ?
ট্রেনিং এর প্রথম দিন খুব ভয় কাজ করছিল, আমাদের ট্রেইনার ছিলেন নুসরাত জাহান ম্যাডাম, সুমন হাবিব স্যার, রফিকুল ইসলাম তালুকদার স্যার। শুরুতেই ট্রেইনার আপা অনেক কিছু বললেন কম্পিউটার ব্যবহার সম্পর্কে খুব মন দিয়ে শুনলাম, মনে মনে আগ্রহ সৃষ্টি হতে লাগলো, ভাবলাম আমি পারবো ইনশাআল্লাহ।
একদম মাউস ধরা থেকে শুরু করে ল্যাপটপ অন-অফ, ওয়ার্ডে লিখা, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, এক্সেল ইত্যাদি মোটামুটি আয়ত্ব করলাম। যতোই ট্রেনিং এর দিন শেষ হতে লাগলো ততোই যেন কাজ করার আগ্রহ বাড়তে লাগলো আমার।
একদিন পরিচিত হলাম শিক্ষক বাতায়ন প্লাটফর্মের সাথে ট্রেইনার আপা পরিচিত করিয়ে দিল শিক্ষক বাতায়নের বিভিন্ন ফিচারের সাথে, এর যে ফিচারটা আমাকে আলোড়িত করেছিল তা হলো সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা, যেখানে প্রতি মাসে অনেক অনেক কন্টেন্ট থেকে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে তিন জনকে সেরা কনটেন্ট নির্মাতা করা নির্বাচিত করা হতো ।
আমার লালিত স্বপ্নরা আমাকে বলছে এবার তুমি তোমার স্বপ্নের সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠে যাও, তখন কল্পনায় স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম সারা বাংলাদেশের শিক্ষকদের জনপ্রিয় পোর্টাল শিক্ষক বাতায়নে আমাকে দেখবে !
কেমন হবে সেই দিনটি ?
জীবনের মোর ঘুরে গেল। অন্যদিকে পরিবার, সন্তান, বিদ্যালয় আর শিক্ষক বাতায়ন! শুরু করলাম কনটেন্ট তৈরির কাজ। ডিজিটাল কনটেন্ট দিয়ে ক্লাস করি আর বাতায়নে আপলোড করি , আমি যখন ডিজিটাল কনটেন্ট দিয়ে ক্লাস করি তখন আমার সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে আমার ক্লাস দেখেন , মাঝে স্কুলে অভিভাবকরাও আসতো আমার ক্লাস দেখতে। এসে বলতো, মেডাম নাকি সব কিছু পর্দায় দিয়ে ক্লাস করান সেটা কীভাবে? দেখা যেত আমার ক্লাস করার জন্য বাচ্চারা অধির আগ্রহ নিয়ে বসে থাকত, মনোযোগী থাকতো বেশী, ইন-হাউজের মাধ্যমে আমার বিদ্যালয় ও পার্শ্ববতী বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করা শিখিয়েছি। শিক্ষক বাতায়ন থেকে কনটেন্ট ডাউনলোড করে দিয়েছি দেশের বিভিন্ন জেলায় মেইল, কুরিয়ারের মাধ্যমে ডিজিটাল কন্টেন্ট পাঠিয়েছি। সেই সুবাদে পরিচিত হতে লাগলাম সারাদেশের শিক্ষকদের সাথে। সারাদিন স্কুল, সংসার, সন্তান আর রাত-ভর কনটেন্ট তৈরি। কখনও কখনও এমন হয়েছে আজান হচ্ছে আর আমি তখনো ঘুমাই-নি !
আহা ! স্বপ্ন ! শিক্ষক বাতায়নে বার বার দেখতাম সেরা কনটেন্ট নির্মাতাদের , আর মনে হতো আমিও যদি এভাবে বাতায়নের আকাশে ভাসতে পারতাম।
ট্রেনি এর ঠিক মাস খানেক পরই এলো আমার জীবনে সেই আনন্দঘন দিন। জুন মাস ২০১৪ ছিল সম্ভবত ১৫ তারিখ ভোরে ময়মনসিংহ থেকে আমাদের সবার প্রিয় আনোয়ারা আপা, আমাকে ফোন দিয়ে জানালো সেই স্বপ্ন পূরণের গল্পটা, আমি ভেবেছি সত্যিই গল্প ! কিন্তু যখন বাতায়নে প্রবেশ করি দেখি নিজের ছবি সত্যিই সেই আনন্দের সময়টাকে ভেবে এখনও আন্দোলিত হই, শিহরিত হয়ে উঠি। আমার প্রাণের বাতায়ন আমাকে আমার স্বপ্ন পূরণ করিয়েছে, আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে, আমাকে আলোকিত করেছে। সারাদেশের শিক্ষকদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমার টাঙ্গাইল জেলায় শিক্ষক বাতায়নে প্রথম সেরা কনটেন্ট নির্মাতা আমি শাহানারা আক্তার হ্যাপি, তখন ওই আনন্দ বইছিল সারা টাঙ্গাইলে, আমার পরিবারে, আমার বিদ্যালয়ে।
২০১৭ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর, এটুআই কর্তৃক বাংলাদেশে প্রথম ৬৮ জনের মধ্যে আমার জেলা হতে আমিই প্রথম টাঙ্গাইল জেলা অ্যাম্বাসেডর শিক্ষক মনোনীত হই। শিক্ষক বাতায়ন ও এটুআই এর সাথে পরিচয়ের মাধ্যমেই আমার জীবনের গল্পগুলো এক এক করে বদলাতে থাকলো।
সেই প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষক শাহানারা আক্তার হ্যাপি জেলা মাস্টার ট্রেইনার , জেলা অ্যাম্বাসেডর আর আমিই প্রথম আমার জেলায় নারী মাস্টার ট্রেইনার ও জেলা অ্যাম্বাসেডর।
আমি ২০১৬ সাল থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাথে কাজ করে আসছি , ইন্টারন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে বিশ্বের প্রায় ১০ টি স্কুলের সাথে আমার স্কুলের কানেক্টিভিটি ছিলো, আমি জয় করেছিলাম British Council International School Award 2017-2019 । সনদ ও সম্মাননা ক্রেস্ট গ্রহণ করি তখনকার শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী , বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী জনাব মুহিবুল হাসান নওফেল মহোদয়ের হাত থেকে ।
আলহামদুল্লিলাহ! আমার উপজেলায় ২০১৭ , ২০১৮, ২০১৯ , ২০২১, ২০২২ ও ২০২৪ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছি।
করোনা মহামারীর সময়ে নিজ বিদ্যালয় এবং দেশের অন্যান্য জেলার অনলাইন স্কুল গুলোতে
আমি নিয়মিত অনলাইনে প্রায় শতাধিক ক্লাস ও লাইভ ক্লাস নিয়ে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত
ছিলাম।
২০২০ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর, জনপ্রিয় প্লাটফর্ম শিক্ষক বাতায়নে সেরা উদ্ভাবক (Best Innovator) এর স্বীকৃতি অর্জন করি যা আমার জীবনের আরও একটি বড় সফলতা।
শিক্ষাক্ষেত্রে যে নতুন বিপ্লব, নতুন কারিকুলাম এসেছে, আলহামদুলিল্লাহ! এই নতুন কারিকুলামের বাংলা বিষয়ের জেলা পর্যায়ের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে যুক্ত আছি।
আমার বিদ্যালয়ে আমার শিক্ষার্থীরা এই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থাকে চমৎকার ভাবে মেনে নিয়েছে। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, আমার প্রতিটি শ্রেণিতে বেড়েছে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, প্রতিটি ক্লাসেই লক্ষ্য করি ওদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষার্থীরা ছবি, বর্ণধারা, ভূমিকা-অভিনয়, বিতর্ক, গল্প বলা-শোনা, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদির মাধ্যমে ওরা শিখছে। নান্দনিকভাবে নিজেরাই শিখছে প্রশ্ন তৈরি করা, আবার ওরাই সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, ক্লাসে তৈরি হচ্ছে চমৎকার একটা শিখন পরিবেশ। নতুন কারিকুলামের মূল্যায়নের জন্য যে নৈপূন্য অ্যাপ রয়েছে, এই অ্যাপের জেলা সার্পোট টিমের সাথে কাজ করে যাচ্ছি।
আলহামদুলিল্লাহ! এই সকল সফলতা একমাত্র এটুআই এর জন্য, এই এটুআই ই আমার সফলতার
চাবিকাঠি কারণ এটুআই এর মাধ্যমে শিক্ষক বাতায়ন দিয়েই সারাদেশে আমার পরিচিতি। আর
আমার সাফল্যের নেপথ্যে যারা আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়েছেন তারা আমার পরিবার আমার
স্বামী, সন্তান, আমার মা, ভাই-বোন। প্রতিটি কাজের পেছনেই আমার পরিবার আমাকে
সাপোর্ট দিয়েছে, সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ আমার পরিবারের কাছে।
শাহানারা আক্তার হ্যাপি
সহকারী শিক্ষক
কালিয়াপাড়া ডাকাতিয়া মাজেদা মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়।
সখিপুর, টাঙ্গাইল ।