Loading..

সফলতার গল্প

স্বপ্ন থেকে সফলতা
article

পথচলার শুরুটা যেভাবে.....

কথায় আছে-‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়ো’ কিন্তু আমার মনে হয়-‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান নয়; তার চেষ্টার সমান বড়ো’। যার চেষ্টা যত বেশি, তার স্বপ্ন ততো বড়ো। স্বপ্ন দেখতে সবাই ভালোবাসে কিন্তু আমার স্বপ্নটা আর পাঁচজনের মতো ছিল না। আমার কাছে স্বপ্ন মানে ছিল-নিজেকে সবার সামনে মেলে ধরা; নতুন নতুন কর্মযজ্ঞ দিয়ে সফলতাকে ছুঁয়ে দেখা। উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর শিক্ষকতা পেশাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে যখন ২০০৬ সালে রাজশাহী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহীতে ‘সহকারী শিক্ষক (বাংলা)’ হিসেবে যোগদান করি, ঠিক তখন পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের ধারণাটা মোটেও ছিল না। পাওয়ার পয়েন্ট, প্রেজেন্টেশন এগুলোর ব্যাপারে একবারেই অজ্ঞ ছিলাম। জানাই ছিল না যে, কোনো পাঠকে স্ক্রিনে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের আনন্দময়তার সাথে পড়ানো যায়। ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে যে ক্লাস নেওয়া যায়, এমন ধারণা আমি প্রথম পাই ‘শিক্ষক বাতায়ন’ থেকে। শুরু হয় স্বপ্ন বোনা। ‘কিছু অজ্ঞতা আর কিছু দক্ষতা’ এই নিয়ে কাজ শুরু করি বাতায়নকে ঘিরে। ‘শ্রম আর আবেগের’ সংমিশ্রণে সংশপ্তকের মতো শিক্ষক বাতায়নের উর্বর ক্ষেত্রে একের পর এক স্বপ্ন বুনে পেয়েছি অবর্ণনীয় ভালোলাগা ও প্রভূত সাফল্য যা আমাকে অভিজ্ঞতায় করেছে ঋদ্ধ, মানুষের ভালোবাসায় করেছে সিক্ত আর আমার পরিশ্রমকে করেছে নন্দিত।

 


সফলতার ঝুড়িতে যা জমেছে.....

সান্ধ্যপ্রদীপ জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকাতে হয়, ঠিক তেমনি শিক্ষক বাতায়নে নিজেকে মেলে ধরার আগে NING নামক একটি সাইটে নিজেকে অভিযোজিত করেছিলাম। সালটা সম্ভবত ২০১০ ছিল। তারপর এটুআই এর উদ্যোগে ২০১১ সালে দেশব্যাপী শিক্ষকদের মাঝে শুরু হলো ‘জাতীয় কনটেন্ট প্রতিযোগিতা। ২০১৪ সালের প্রতিযোগিতায় একরাশ ভয় ও আকুণ্ঠ আত্মবিশ্বাস নিয়ে অনেক জ্ঞানী-গুণী-প্রযুক্তিবিদদের সাথে নিজেকে দাঁড় করালাম। সেবার সেরাদের তালিকায় নাম লিখাতে পারিনি কিন্তু বিভাগীয় পর্যায় থেকে অনেক কিছু নিয়েই বাড়ি ফিরেছিলাম। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম এই জন্য যে, এই সেক্টরে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদচারণা একেবারেই অপ্রতুল। নিজেকে সংখ্যালঘু ভেবে এই হতাশায় বেশ কিছুদিন থমকে ছিলাম। কিন্তু নিজেকে জয় করার অদম্য ইচ্ছে আমাকে স্থির থাকতে দেয়নি। নব উদ্যমে শুরু করেছি আবার। কাজ করে গেছি অহর্নিশ। ক্লান্ত হয়েছি, মাঝে মাঝে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব করে হতাশ হয়েছি কিন্তু ক্ষান্ত দেইনি; নির্লিপ্তভাবে লেগে থেকেছি।

 


আমার জীবনে সফলতার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল ২০১২ সালে। সে বছরের এপ্রিলে হঠাৎ একদিন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটা ফোন আসলো। দক্ষিণ কোরিয়ায় আইসিটিতে প্রশিক্ষণ যাওয়ার আমন্ত্রণের ফোন। আহা! কী আনন্দ.... আকাশে বাতাসে....!!। ১৪ দিনের প্রশিক্ষণ। সেদিন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলাম। প্রশিক্ষণ শেষে সে দেশের সরকার আমার হাতে তুলে দিল Core i5 মানের Samsung ব্র্যান্ডের একটি ল্যাপটপ। তারপর থেকে কাজের স্পৃহা যেন বহুগুণে বেড়ে গেল। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। বুকের মাঝে ইয়া-বড়ো একটি স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে শাণিত করতে লাগলাম শিক্ষক বাতায়নে সেরা হওয়ার জন্য। অনেক সাধনা ও বিরামহীন প্রচেষ্টার ফল হিসেবে সে সাফল্য একদিন হাতের মুঠোয় এসে ধরাও দিল। অবশেষে ১৮.০২.২০১৮ তারিখ প্রভাতে সূ্য্যিমামা জেগে উঠার আগেই বাতায়নের আকাশে ‘সাপ্তাহিক সেরা কন্টেন্ট নির্মাতা’ হয়ে উদিত হলাম। সে আনন্দ অনির্বচনীয়। তার কিছুদিন বাদেই মনোনীত হলাম ICT4E জেলা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে, দায়িত্বের মাত্রাটা আরেকটু বেড়ে গেল। করোনাকালীন কাজের অভিজ্ঞতাটা আরও মধুর ছিল। আমার ব্যাকরণ ক্লাস দিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় অনলাইন স্কুল ‘রংপুর অনলাইন স্কুল’-এ আমার অনলাইন ক্লাসের হাতেখড়ি হলো। তারপর ‘রাজশাহী বিভাগীয় অনলাইন স্কুল এন্ড কলেজ’ এর পরিচালনা পর্ষদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ও ক্লাস নেওয়ার সুযোগ হলো। তারপর ‘নরসিংদী অনলাইন স্কুল’, ‘বরিশাল অনলাইন স্কুল’ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অনলাইন স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ হলো। শিক্ষক বাতায়নের সহযোগী প্ল্যাটফর্ম ‘কিশোর বাতায়ন’ এর মাধ্যমিক স্তরের বাংলা শিক্ষক হিসেবেও একাধিক ক্লাস নেওয়ার সৌভাগ্য হলো। করোনার ফুরসতকে কাজে লাগিয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে ০১.০৫.২০২০  তারিখে শিক্ষক বাতায়নের ‘পাক্ষিক সেরা উদ্ভাবক’ ও ১৮.০৭.২০২১ তারিখে ‘সেরা অনলাইন পারফর্মার’ হওয়ার তকমাটাও সফলতার ঝুড়িতে যুক্ত করতে সমর্থ্য হলাম। এছাড়াও মাধ্যমিক স্তরের ‘কারিকুলাম বিস্তরণ’, ‘বাংলা’, ‘জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা (LSBE)’ ও New Curriculum Dissemination-এ বাংলা বিষয়ের ‘জেলা মাস্টার ট্রেইনার’ হিসেবে সফলভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

 


২০১৮ সালের সাফল্যটা ছিল আরও হিরণ্ময়। এটাই যেন জীবনের সেরা ও পরম প্রাপ্তি। আমি তখনও রাজশাহী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহীতে কর্মরত। মাসটা মে। তখন আমি স্কুলের ILC (ICT Learning Centre) ল্যাবের দায়িত্বে। ডাক পড়লো পৃথিবীর একপ্রান্তের সবুজ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো দেশ নিউজিল্যান্ডে প্রশিক্ষণের জন্য। নিউজিল্যান্ডের বৃহত্তম দুই শহর Wellington ও Auckland-এ ৭দিন করে ১৪ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম। সে অভিজ্ঞতাও অনির্বচনীয়। এছাড়াও মুক্তপাঠের রিসোর্সপুল সদস্য ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হওয়ার সফলতাটাও জীবনের আরেকটা বড়ো অর্জন। মুক্তপাঠের বিভিন্ন অনলাইন কোর্স যেমন: ই-লার্নিং অনলাইন কোর্স, Facebook-Meta, MyGov, Noipunno, ‘আর্থিক ব্যবস্থাপনা অনলাইন কোর্স’ অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা (GRS) ইত্যাদি অনলাইন কোর্সের ভিডিয়ো নির্মাণ করেছি সফলতার সাথে। সফলতার আরেকটি অনন্য মাইলফলক হিসেবে বলা যায়- করোনাপরবর্তী শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য জাতীয় উদ্যোগ হিসেবে DPE, DSHE ও UNICEF এর নেতৃত্বে CSSR প্রজেক্টের মাধ্যমে ‘বিটিভি’ ও ‘সংসদ টিভি’ তে ক্লাস নেওয়ার সৌভাগ্য; টিভিক্লাস আমাকে আরেক সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। আমি কোনোদিন ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি যে, ‘অনলাইন ক্লাসের অভিজ্ঞতা আমাকে টিভি ক্লাসে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে।’

 


অতএব হৃদয়ানুভূতি.....

শিক্ষক বাতায়নে যুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার পৃথিবীটা খুব ছোট্টো ছিল, আমার কাজের জগতে আমি ছিলাম একক বাসিন্দা। আজ আমি অ-নে-ক বড়ো একটা পরিবারের সদস্য। এই প্ল্যাটফর্মের বদৌলতে তারকাশিক্ষকদের গ্যালাক্সিতে আমারও ঠাঁই হয়েছে, অন্যান্য গুণীদের আলোয় মিটমিট করে জ্বলবার সুযোগ পেয়েছি। কাজ করার সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ভালোবাসা পেয়েছি অগণিত মানুষের। জীবনে এর চাইতে বড়ো সফলতা আর কী হতে পারে!

সফলতার সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম। আমার কাছে সফলতা মানে-মানুষের ভালোবাসা পাওয়া, আমার কাছে সফলতা মানে-নিজের উপর নির্ভরতায় আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে যাওয়া, আমার কাছে সফলতা মানে-নিজের স্বপ্নগুলোকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তার পরশ নেওয়া এবং স্বপ্নের ফুলগুলোকে ফুটিয়ে তার সৌরভ সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া। ‘সময়ের সদ্ব্যবহার ও শ্রম কখনও কাউকে ঠকায় না’- সর্বদা এ বিশ্বাস বুকে নিয়েই পথ চলেছি। এখনও প্রাণের শিক্ষক বাতায়নের সাথে যুক্ত থেকে সময়ের চাহিয়া অনুযায়ী অহর্নিশ বহুমুখী কাজ করে যাচ্ছিশিক্ষক বাতায়নের হাত ধরেই আমি হতে চাই ‘স্মার্ট শিক্ষক’ আর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে যেতে চাই বহুদূর...।



আহমাদ হোসাইন

বিএ (সম্মান), এমএ (বাংলা)

বিএড (১ম শ্রেণি), এমএড (১ম শ্রেণি)

সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)

গভঃ ল্যাবরেটরী হাইস্কুল রাজশাহী


মন্তব্য করুন