হাওর থেকে অরণ্য
আমি তাহমিনা আক্তার। প্রধান শিক্ষক, উচাইল হোসেনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার।ছোটবেলা কেউ যখন জিজ্ঞেস করত লেখা পড়া শিখে কী হতে চাও ? তখন অন্য সবার মতো আমিও বলতাম ডাক্তার হতে চাই. মানুষের সেবা করতে চাই। মূলত তোমার জীবনের লক্ষ্য রচনা পড়তে পড়তেই এই ধারণা মূখস্থ হয়ে গিয়েছিল। যদিও স্কুলে স্যার ম্যাডমাদের দেখে মনোবাসনা ছিল শিক্ষক হবার। মহান রব উত্তম পরিকল্পনাকারি। তিনি মানূষের মনের ভাষা বুঝেন তা যতই গোপন থাকুক না কেন।
স্বপ্ন দেখার শুরু এসএসসি পরীক্ষার পর থেকেই। ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হলাম বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা কলেজে। খালার বাড়ি থেকে পড়ালেখা করতাম। তারপর এইচএসসি পাশের পর অনার্সে ভর্তি হলাম সিলেট এমসি কলেজে। অনার্স ২য় বর্ষে পরীক্ষা দেবার পর পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু আমার পরিবার খুবই হেল্পফুল থাকায় আমার স্বপ্ন পূরণের পথে কোনো বাধাই আসেনি, পরিবারের সবার সম্মতিতেই ভালোভাবে পড়া লেখা চালিয়ে যেতে থাকলাম এবং নিয়মিতভাবেই সাফল্যের সাথে মাস্টার্স সম্পন্ন করলাম। পরিবার থেকে কোনো বাঁধা আসেনি। তারপর যেদিন মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট হলো তার কিছুদিন পর আমার ছেলের জন্ম হলো। স্বাভাবিক ভাবেই চাকুরীর প্রিপারেশন নিতে পারিনি। কিন্তু মনে অদম্য মনোবল ছিল যে আমি পারব ইনশাআল্লাহ। বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ থেকে অফার পাচ্ছিলাম, কিন্তু বাচ্ছা ছোট থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কিন্তু স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে নি, আমি বরাবরই আত্মবিশ্বাসী মানুস। এর মধ্যে একটা ব্যাংকেও এপ্লাই করেছিলাম সেখান থেকে ডাক ও পেয়েছিলাম। কিন্তু কেন জানিনা মন থেকে সাঁয় পাচ্ছিলাম না। এরই মধ্যে ২০০৮ সালে একটা ইঙ্গলিশ মিডিয়াম স্কুল এন্ড কলেজে যোগদান করি এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহাকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক পদের সার্কুলার প্রকাশিত হলে আবেদন করি। ২০০৯ সালে অনলাইনে আবেদন ছিলনা এবং মোবাইলে এস এম এস এর মাধ্যমে পরীক্ষার তারিখ এবং আসন বিন্যাস জানানোর প্রচলণ ছিলনা। ডাকযোগে চিঠিপত্র আসত। যথারিতী সহকারী শিক্ষকের রিটেন পরীক্ষার জন্যে চিঠি আসে এবং পরীক্ষায়্ব এটেন্ড করি এলাউও হই কিন্তু যখন পোস্টিং এর জন্যে যখন চিঠি আসে তখন চিঠি পেয়ে হতাশ হয়ে যাই কারণ পোস্টিং ছিল বাড়ি থকে ৩২ কিমি দূরে একটা স্কুলে, একদম বর্ডার এড়িয়ায়। পরিবারের সবার ঘোর আপত্তি এত দূরে যেতে দিবেন না। কিন্তু এগিয়ে আসেন আমার শ্বাশুড়ি। উনার সহায়তায় সবাইকে বুঝিয়ে ২০০৯ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি বাড়ি থেকে প্রায় ৩২ কিমি দূরে প্রত্যন্ত এলাকার এক বিদ্যালয়ে। যেদিন প্রথম বিদ্যালয়ে যোগদান করি ১২ মে ২০০৯ সাল। ঐদিন পুরো দেশব্যাপী চলছিল ঘুর্ণিঝড় আইলা”র তাণ্ডব। প্রচণ্ড খারাপ আবহাও্য়া ও ঝড়ের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি থাকায় সকাল ৮ ঘটিকায় বিদ্যালয়ে পৌঁছি। সেই সময় ঘড়ির টাইম একঘন্টা পিছিয়ে আনা হয়েছিল তাই সকাল ৮টা থেকে ক্লাস শুরু হতো। এভাবেই চলছিল কিছুদিন। নিজের গাড়ি করে স্কুলে যেতাম, মাঝে মাঝে পাবলিক বাসে।
একদিন সকাল বেলা বাসে করে যাওয়ার সময় সকাল ৭ টার বাসে উঠি, সে সময় বাসে উঠেন আমার ক্লাস্টার অফিসার জনাব আব্দুল মান্নান মিয়া স্যার। স্যার ও স্কুল ভিজিটে যাচ্ছিলেন।আমি তখন সবে মাত্র নূতন জয়েন করেছি স্যারকে চিনতাম না, স্যার ও আমাকে চিনতেন না, বাসে যেতে যেতে স্যারের সাথে কথা হয় ও স্যার আমার পরিচয় জানতে পারেন। স্যার তখন একটা কথা বলেছিলেন যে, যে শিক্ষক এত দূর থেকে এসে সকাল ৭ টার বাস ধরতে পারে সে একদিন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবে ইনশাআল্লাহ। স্যারের এই কথাটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল এবং সেদিন বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
এই সময়ে আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন আমাদের তৎকালীন উপজেলা শিক্ষা অফিসার জনাব সাহাব উদ্দিন স্যর। স্যারের সহায়তায় মোটামূটি কাছাকাছি একটা স্কুলে বদলি হয়ে আসি। সেখানে ৬ মাস চাকুরি করার পর সিইনএড প্রশিক্ষণে চলে যাই। সিইনএড প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রধান শিক্ষক পদের জন্যে রিটেন এবং ভাইবা পরীক্ষাইয় অংশগ্রহণ করি এবং উত্তীর্ন হই। তারপর সিইন এড প্রশিক্ষণ শেষ করে নন্দীরগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করি বাড়ি থেকে প্রায় ১৮ কিমি দূরে। সেখানে সফলতার সাথে কাজ ৪ বছর অতিবাহিত করার পর বাদে ভূকশিমইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করি। প্রায় দীর্ঘ নয় বছর উক্ত বিদ্যালয়ে ছিলাম্। বিদ্যালয়টি ছিল হাকালুকি হাওর কোল ঘেঁষে অবস্থিত একটি প্রত্যন্ত এলাকায়।বছরে তিন/চার মাস পানিতে নিমিজ্জিত থাকত ফলে পাঠদান ও বন্দ থাকত। তারপরেও প্রতি বছর সমাপনী পরীক্ষায় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখত, উপজেলার মধ্যে ফলাফলের মধ্যে সেরা দশে ছিল।২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনলাইন বদলির দ্বার উন্মুক্ত হলে নিজের এলাকায় বদলি হয়ে আসি।
২০১৬ সালে অধিদপ্তর কতৃক আমার ইনোভেশন
আইডিয়া ‘এসো পড়ি’ এবং ২০১৯ সালে ইনোভেশন আইডিয়া আমার পণ নির্বাচিত হয়।
আমি ২০১৯ সালে শিক্ষকদের জনপ্রিয় প্লাটফর্ম শিক্ষক বাতায়ন কর্তৃক আইসিটি ফর ই জেলা অ্যাম্বাসেডর’’ এর স্বীকৃতি পেয়েছি এবং ২০২০ সালে কোভিডকালীন সময়ে এটুয়াই থেকে পরিচালিত’ ঘরে বসে শিখি ‘’ সহ বিভিন্ন অনলাইন পেজে প্রায় তিন শতাধিক অনলাইন ক্লাস নিয়েছি যা শিক্ষক বাতায়নের রুটিনে এন্ট্রিকৃত আছে।
আমি ২০১৪ সাল থেকে বিষয়ভিত্তিক বিজ্ঞান প্রশিক্ষক এবং ২০২০ সাল থেকে গণিত অলিম্পিয়াড মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়াও আমি ২০২৪ সালের মার্চ মাসে পাক্ষিক সেরা উদ্ভাবক নির্বাচিত হই
২০২৪ সালে জাতীয় ইনোভেশন শোকেশিং প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে আমি ৩য় স্থান অধিকার করি।
আমার চলার পথ যেন মসৃণ হয়, আমি সবার দোয়া ও আশীর্বাদ কামনা করি।
তাহমিনা আক্তার
প্রধান শিক্ষক
উচাইল হোসেনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
কুলাউড়া, মৌলভীবাজার।