Loading..

প্রেজেন্টেশন

০৪ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ০৯:৩৩ অপরাহ্ণ

শল্যচিকিৎসার পথিকৃত মুসলিম বিজ্ঞানী আবুল কাসেম জাহরাভি

 শল্যচিকিৎসার পথিকৃত মুসলিম বিজ্ঞানী আবুল কাসেম জাহরাভি 


আবুল কাসেম খালাফ ইবনে আল-আব্বাস আল-জাহরাভি। ইসলামের সোনালী যুগের যে সব  মুসলিম বিজ্ঞানী জগৎকে আলোকিত করেছেন তিনি তাদের অন্যতম। বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই রয়েছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবিস্মরণীয় অবদান। মুসলিম বিজ্ঞানী আল-জাহরাভি ছিলেন আধুনিক সার্জারিবিদ্যার পথিকৃৎ।

আবুল কাসেম জাহরাভি এর পরিচয়ঃ
৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের আন্দালুসিয়ার আজ-জাহরা শহরে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা সম্ভবত আল-আনসারি গোত্রের সদস্য ছিলেন। জীবনের প্রায় পুরো সময়ই তিনি স্পেনের কর্ডোভায় কাটিয়েছেন। এ শহরেই তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ডাক্তারি। আন্দালুসিয়ার খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকামের রাজচিকিৎসক ছিলেন তিনি। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি আজ-জাহরা শহরে স্থানান্তরিত হন এবং বাকি জীবনটা সেখানেই কাটান। ১০১৩ খ্রিস্টাব্দে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

ইতিহাসবিদদের মতে, তিনি নিজেই তাঁর আত্মজীবনী লিখে গিয়েছিলেন। তা ছাড়া তাঁর জীবদ্দশায় অনেকেই তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, ক্যাস্টিলিয়ান ও আন্দালুসিয়ানদের মধ্যকার যুদ্ধে আজ-জাহরা শহর ধ্বংস হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায় এসব অমূল্য তথ্যও।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল বলেন, ‘আবুল কাসেমের চিকিৎসা পদ্ধতি এতটাই উন্নত ছিল যে ইউরোপীয়রা অন্ধের মতো অনুকরণ করত তাঁকে। তাঁর দেখানো পথে চলেই ইউরোপে শল্যচিকিৎসা আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে!


 
‘কিতাবুল তাসরিফ
চিকিৎসাবিজ্ঞানের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে তাঁর লিখিত ‘কিতাবুল তাসরিফ’-এর মাধ্যমে। এটি ছিল চিকিৎসাসংক্রান্ত ৩০ খণ্ডের বিশ্বকোষ। সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অপথালমোলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসা—সবই স্থান পেয়েছে তাঁর এই গ্রন্থে। শল্যচিকিৎসার প্রক্রিয়া ও যন্ত্র নিয়ে তাঁর অবদান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আধুনিক কালেও প্রভাব ফেলেছে। তাঁর রচিত ‘কিতাবুল তাসরিফ’ গ্রন্থে দুই শতাধিক অস্ত্রোপচারের সচিত্র বর্ণনা দিয়ে সে সময়কার চিকিৎসকদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেন তিনি। বর্তমান সময়েও সেগুলো চিকিৎসকদের বিস্মিত করে। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্র কিছু কিছু বিষয়ে এখনো ব্যবহার করা হয়। আন্দালুসিয়ার খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকামের উদ্যোগে আবুল কাসেমের ৫০ বছর নিরলস পরিশ্রমের ফল এই অমূল্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

 
এক্টোপিক গর্ভধারণ
চিকিৎসকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম এক্টোপিক গর্ভধারণ নিয়ে বর্ণনা করেছেন। উল্লেখ্য, জরায়ুর বাইরে যেকোনো স্থানে গর্ভধারণ হলে তাকে এক্টোপিক গর্ভধারণ বলে। জরায়ু সম্প্রসারণের জন্য প্রথম সফল অস্ত্রোপচার করেছিলেন এই কিংবদন্তি। এ ছাড়া মৃত ভ্রূণ বের করার যন্ত্রটিও সর্বপ্রথম তিনিই আবিষ্কার করেছেন।

 
হাইড্রোসেফালাস
পৃথিবীতে প্রথম হাইড্রোসেফালাস সমস্যার (বড় মাথার রোগ) সমাধানও তিনিই উদ্ভাবন করেছিলেন। হাইড্রোসেফালাস রোগটি সাধারণত শিশু ও বৃদ্ধদের বেশি হয়। এই সমস্যাকে অনেক সময় ‘মাথায় পানি জমা’ও বলা হয়। জাহরাভি তাঁর ‘কিতাবুল তাসরিফে’ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সবিস্তারে তুলে ধরেছেন।

 
‘মিশাব’ যন্ত্র
ইউরোলজিতেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনিই প্রথম লিথোটমি বা কাটাছেঁড়াবিহীন মূত্রথলির পাথর অপসারণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘মিশাব’ যন্ত্র (যা অনেকটাই আধুনিক যুগের লিথোট্রাইটের মতো)। এটি ব্যবহার করে কোনো রকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই মূত্রথলির ভেতরেই পাথর ভেঙে ফেলা হতো।

 

এ ছাড়া তিনি মাথার আঘাত, মাথার খুলির অস্থিতে ফাটল, মেরুদণ্ডীয় জখম চিকিৎসায় বেশ পটু ছিলেন। এসব চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি এমন কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম ও প্রায়োগিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, যেগুলোর একটা বড় অংশ এখনো নিউরোসার্জারিতে ব্যবহৃত হয়! পৃথিবীতে প্রথম সফলভাবে দাঁত ট্রান্সপ্লান্ট করে দেখিয়েছিলেন তিনি। তিনি ব্রোঞ্জ ও রুপা দিয়ে দাঁত বাঁধাই করতেন। এসব অস্ত্রোপচারে তিনি যেসব সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছেন, সেগুলোর একটি বড় অংশ আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।

 
চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অবদান
চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে রেনেসাঁর সময়ের এক বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক পিয়েত্রো আরগালাতা বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে তিনি সব শল্যচিকিৎসকের মাস্টার!’ এ ছাড়া ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ শল্যচিকিৎসক গাই ডি কলিক তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। কর্ডোভায় যে গলিতে তিনি বসবাস করতেন, সেই গলিটির নাম করা হয়েছে ‘আবুল কাসেম স্ট্রিট’, এমনকি যে বাড়িটিতে তিনি বসবাস করতেন, সেই বাড়িও সংরক্ষণ করেছে স্পেন সরকার। আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানীর বাড়ির সামনে একটি ব্রোঞ্জ প্লেট লাগানো আছে। সেখানে লেখা আছে, ‘এটিই সেই বাড়ি, যেখানে আল জাহরাভি বসবাস করতেন।’ জাহরাভির স্মৃতি চিরস্থায়ী করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নির্মাণ করা হয়েছে জাহরাভি হাসপাতাল। সর্বোপরি, শুধু শল্যচিকিৎসা নয়, চিকিৎসাশাস্ত্রই আজীবন ঋণী হয়ে থাকবে মুসলিম এই চিকিৎসকের কাছে।