Loading..

ম্যাগাজিন

০৫ নভেম্বর, ২০২০ ০৮:১৮ অপরাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্ত্বা। একজন সন্তানের জন্মের সাথে তার পিতার সম্পর্ক যেমন থাকে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক।

 ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ লৎফুর রহমান মাতা সায়েরা খাতুন। তিনি ছিলেন বাংলার ভাগ্যাকাশে আবির্ভূত এক নতুন সত্ত্বা,এক নতুন ধূমকেতু। 

১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছিল। কিন্তু অল্প দিনেই বাঙালীরা বুঝতে পারে পাকিস্তান তাদের নয়। প্রথমে ভাষার ওপরে আঘাত দিয়ে শোষণ শুরু করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম আন্দোলনে কারাবরণ করেছিলেন বাঙালীর নেতা শেখ মুজিব। এরপর বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রতিটি বাঙালীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার মন্ত্র। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮’র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬’র ৬ দফা ও পরে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু। এর ভেতর দিয়ে তিনি আবির্ভূত হন বাঙালী জাতির মহানায়ক হিসেবে।

মার্কিন কূটনৈতিক অ্যার্চার ব্ল্যাড তার গ্রন্থে লিখেছেন, শেখ মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানেরমুকুটহীন সম্রাট।তবে এই মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠার পেছনের ইতিহাসটা সবাই গভীরভাবে লক্ষ্য করে থাকবে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে খুবই ভাবাতো। তিনি দুঃখী গরিবের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কঠিন পণ নিলেন। তিনি ভাবলেন কীভাবে জাতির ভাগ্য রচনায় তিনি নতুন ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করবেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণাঞ্চলে লাখ-লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সপ্তাহব্যাপী ঘূর্ণিদুর্গত অঞ্চল ঘুরে ২৬ নভেম্বর ঢাকায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “বাংলাদেশ আজ জেগেছে। বানচাল করা না হলে বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের রায় ঘোষণা করবে। আর যদি নির্বাচন বানচাল করা হয়, ঘূর্ণিঝড় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত দশ লাখ লোক আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে তা সম্পাদনের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতো বাঁচার জন্য এবং আমারা যাতে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্তা হতে পারি, এর জন্য প্রয়োজনবোধে আরো দশ লাখ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দেবে।

নির্বাচনে পূর্ব বাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে বঙ্গবন্ধুর দল পাকিস্তান পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তাছাড়া প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন লাভ করে বঙ্গবন্ধুর দল। এভাবে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিব পূর্ববাংলার জনগণের একমাত্র মুখপাত্রে পরিণত হলেন।

তারপর বিশ্ব মানচিত্রে হাত দিলেন বঙ্গবন্ধু। পরিবর্তন করলেন মানচিত্রের। সংযুক্ত হলো বাংলাদেশের। পাকিস্তানি জনতা যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করলো না, বাঙালির আত্ম-অধিকার নিয়ন্ত্রণের ভার যখন বাঙালি পেল না- জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যখন মুলতবি হয়ে গেল, রাস্তায় নেমে এলো জনতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চলতে লাগলো বাংলাদেশ। ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে মার্চ ১৯৭১ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতাঅমর কাব্যখানি
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়-
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী ?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।


 ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালী জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। মঞ্চে দাঁড়িয়ে মহানায়ক ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর বক্তব্য বাঙালীর প্রাণে প্রবল শক্তি সঞ্চারিত করে। সেই শক্তিতে একটানা দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদ ও দুইলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় প্রিয় স্বাধীনতা।  মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম আত্মত্যাগের ফসলই হচ্ছে আমাদের আজকের বাংলাদেশ।


 মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অন্যান্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বার বার জেল খেটেছেন। ফাঁসির মঞ্চে নিয়েও তাকে মারতে পারেনি পাকিস্তানী শোষকরা। বাঙালী জাতি ও বিশ্ববাসীর তীব্র চাপে কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে।


স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসররা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে নানা ছলা-কলা করতে থাকে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ করেন। তিনি বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়সহ যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের উন্নয়ন কাজে দিনরাত নিয়োজিত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে স্ব-পরিবারে হত্যা করা হয়।

ইতিহাসের এক হিরণ্ময় নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন- তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। ভাবনায়-চেতনায়-বিশ্বাসে তিনি আমাদের প্রতিটি অণু-পরমাণুর অংশীদার। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ তাই এক অভিন্ন। আমাদের জাতিসত্তার চেতনার উন্মেষ হয়েছিল তারই অতি-মানবীয় নেতৃত্বে।
যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরি-যমুনা বহমান
 ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

আরো দেখুন

কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যাইনি