Loading..

প্রেজেন্টেশন

১৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০৯:১৫ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যুপকার-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

প্রত্যুপকার-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

 

লেখক পরিচিতি:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ২৬ শে সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। প্রথমে সংস্কৃত ও পরে ইংরেজি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে তিনি বহু সম্মান ও খ্যাতি লাভ করেন। উনিশ বছর বয়সে বিশেষ পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করে তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। বদান্যতার জন্য জনসাধারণ তাঁকে ‘দয়ার সাগর’ আখ্যা দেয়। একাধারে মহাপণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও খ্যাতনামা লেখকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ সাধারণত কম ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঘটে। ১৮৪১ সালে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত নিযুক্ত হন। তিনি ১৮৫১ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে উন্নীত হন। তিনিই প্রথম ‘বাংলা গদ্যের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কার করেন এবং গদ্য ভাষায় যতি চিহ্নাদি যথাযথভাবে প্রয়োগ করেন। ফলে তাঁর গদ্য হয়ে ওঠে শৈলীসম্পন্ন। এজন্য তাঁকে বলা হয় বাংলা গদ্যের জনক।’ বাংলা বর্ণসমূহ সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে শিশুদের বাংলা বর্ণমালার প্রথম সার্থক গ্রন্থ ১৮৫৫ সালে লেখা তাঁর ‘বর্ণ পরিচয়’। এ গ্রন্থ আজও বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশক। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’ ‘বিদ্যাসাগর চরিত’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’ প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর প্রধান রচনা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

প্রত্যুপকার-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

 

আলী ইবনে আব্বাস নামে এক ব্যক্তি মামুন নামক খলিফার প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, আমি একদিন অপরাহ্ণে খলিফার নিকটে বসিয়া আছি এমন সময়ে, হস্তপদবদ্ধ এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে নীত হইলেন। খলিফা আমার প্রতি এই আজ্ঞা করিলেন, তুমি এ ব্যক্তিকে আপন আলয়ে লইয়া গিয়া রুদ্ধ করিয়া রাখিবে এবং কল্য আমার নিকট উপস্থিত করিবে। তদীয় ভাব দর্শনে স্পষ্ট প্রতীত হইল, তিনি ঐ ব্যক্তির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছেন। আমি তাঁহাকে আপন আলয়ে আনিয়া অতি সাবধানে রুদ্ধ করিয়া রাখিলাম, কারণ যদি তিনি পালাইয়া যান, আমাকে খলিফার কোপে পতিত হইতে হইবে।

কিয়ৎক্ষণ পরে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলাম, আপনার নিবাস কোথায়? তিনি বলিলেন, ডেমাস্কাস আমার জন্মস্থান; ঐ নগরের যে অংশে বৃহৎ মসজিদ আছে, তথায় আমার বাস। আমি বলিলাম, ডেমাস্কাস নগরের, বিশেষত যে অংশে আপনার বাস তাহার ওপর, জগদীশ্বরের শুভদৃষ্টি থাকুক। ঐ অংশের অধিবাসী এক ব্যক্তি একসময় আমার প্রাণদান দিয়াছিলেন।

আমার এই কথা শুনিয়া, তিনি সবিশেষ জানিবার নিমিত্ত, ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম : বহু বৎসর পূর্বে ডেমাস্কাসের শাসনকর্তা পদচ্যুত হইলে, যিনি তদীয় পদে অধিষ্ঠিত হন, আমি তাঁহার সমভিব্যাহারে তথায় গিয়াছিলাম। পদচ্যুত শাসনকর্তা বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিলেন। আমি প্রাণভয়ে পালাইয়া, এক সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়িতে প্রবিষ্ট হইলাম এবং গৃহস্বামীর নিকট গিয়া, অতি কাতর বচনে প্রার্থনা করিলাম, আপনি কৃপা করিয়া আমার প্রাণ রক্ষা করুন। আমার প্রার্থনাবাক্য শুনিয়া গৃহস্বামী আমায় অভয় প্রদান করিলেন। আমি তদীয় আবাসে, একমাস কাল নির্ভয়ে ও নিরাপদে অবস্থান করিলাম।

REPORT THIS AD

একদিন আশ্রয়দাতা আমায় বললেন, এ সময়ে অনেক লোক বাগদাদ যাইতেছেন। স্বদেশে প্রতিগমনের পক্ষে আপনি ইহা অপেক্ষা অধিক সুবিধার সময় পাইবেন না। আমি সম্মত হইলাম। আমার সঙ্গে কিছুমাত্র অর্থ ছিল না, লজ্জাবশত আমি তাঁহার নিকট সে কথা ব্যক্ত করিতে পারিলাম না। তিনি, আমার আকার প্রকার দর্শনে, তাহা বুঝিতে পারিলেন, কিন্তু তৎকালে কিছু না বলিয়া, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।

(২)

তিনি আমার জন্য যে সমস্ত উদ্যোগ করিয়া রাখিয়াছিলেন, প্রস্থান দিবসে তাহা দেখিয়া আমি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। একটি উৎকৃষ্ট অশ্ব সুসজ্জিত হইয়া আছে, আর একটি অশ্বের পৃষ্ঠে খাদ্যসামগ্রী স্থাপিত হইয়াছে, আর পথে আমার পরিচর্যা করিবার নিমিত্ত, একটি ভৃত্য প্রস্থানার্থে প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। প্রস্থান সময় উপস্থিত হইলে, সেই দয়াময়, সদাশয়, আশ্রয়দাতা আমার হস্তে একটি স্বর্ণমুদ্রার থলি দিলেন এবং আমাকে যাত্রীদের নিকটে লইয়া গেলেন। তন্মধ্যে যাহাদের সহিত তাঁহার আত্মীয়তা ছিল, তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিলেন। আমি আপনকার বসতি স্থানে এই সমস্ত উপকার প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। এ জন্য পৃথিবীতে যত স্থান আছে ঐ স্থান আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়।

এই নির্দেশ করিয়া, দুঃখ প্রকাশপূর্বক আমি বলিলাম, আক্ষেপের বিষয় এই, আমি এ পর্যন্ত সেই দয়াময় আশ্রয়দাতার কখনও কোনো উদ্দেশ্য পাইলাম না। যদি তাঁহার নিকট কোনো অংশে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের অবসর পাই, তাহা হইলে মৃত্যুকালে আমার কোনো ক্ষোভ থাকে না। এই কথা শুনিবামাত্র, তিনি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, আপনার মনস্কাম পূর্ণ হইয়াছে। আপনি যে ব্যক্তির উল্লেখ করিলেন, সে এই। এই হতভাগ্যই আপনাকে, এক মাসকাল আপন আলয়ে রাখিয়াছিল।

তাঁহার এই কথা শুনিয়া, আমি চমকিয়া উঠিলাম, সবিশেষ অভিনিবেশ সহকারে, কিয়ৎক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া, তাহাকে চিনিতে পারিলাম; আহ্লাদে পুলকিত হইয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে আলিঙ্গন করিলাম; তাঁহার হস্ত ও পদ হইতে লৌহশৃঙ্খল খুলিয়া দিলাম এবং কী দুর্ঘটনাক্রমে তিনি খলিফার কোপে পতিত হইয়াছেন, তাহা জানিবার নিমিত্তে নিতান্ত ব্যগ্র হইলাম। তখন তিনি বলিলেন, কতিপয় নীচপ্রকৃতির লোক ঈর্ষাবশত শত্রুতা করিয়া খলিফার নিকট আমার ওপর উৎকট দোষারোপ করিয়াছে; তজ্জন্য তদীয় আদেশক্রমে হঠাৎ অবরুদ্ধ ও এখানে আনীত হইয়াছি; আসিবার সময় স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদিগের সহিত দেখা করিতে দেয় নাই; বোধ করি আমার প্রাণদণ্ড হইবে। অতএব, আপনার নিকট বিনীত বাক্যে প্রার্থনা এই, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার পরিবারবর্গের নিকট এই সংবাদ পাঠাইয়া দিবেন। তাহা হইলে আমি যথেষ্ট উপকৃত হইব।

তাঁহার এই প্রার্থনা শুনিয়া আমি বলিলাম, না, না, আপনি এক মুহূর্তের জন্যও প্রাণনাশের আশঙ্কা করিবেন না; আপনি এই মুহূর্ত হইতে স্বাধীন; এই বলিয়া পাথেয়স্বরূপ সহস্র স্বর্ণমুদ্রার একটি থলি তাহার হস্তে দিয়া বলিলাম, আপনি অবিলম্বে প্রস্থান করুন এবং স্নেহাস্পদ পরিবারবর্গের সহিত মিলিত হইয়া সংসারযাত্রা সম্পন্ন করুন। আপনাকে ছাড়িয়া দিলাম, এ জন্য আমার ওপর খলিফার মর্মান্তিক ক্রোধ ও দ্বেষ জন্মিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি আপনার প্রাণ রক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে সে জন্য আমি অণুমাত্র দুঃখিত হইব না।

আমার প্রস্তাব শুনিয়া তিনি বলিলেন, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমি কখনই তাহাতে সম্মত হইতে পারিব না। আমি এত নীচাশয় ও স্বার্থপর নহি যে, কিছুকাল পূর্বে, যে প্রাণের রক্ষা করিয়াছি, আপন প্রাণরক্ষার্থে এক্ষণে সেই প্রাণের বিনাশের কারণ হইব। তাহা কখনও হইবে না। যাহাতে খলিফা আমার ওপর অক্রোধ হন, আপনি দয়া করিয়া তাহার যথোপযুক্ত চেষ্টা দেখুন; তাহা হইলেই আপনার প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হইবে। যদি আপনার চেষ্টা সফল না হয়, তাহা হইলেও আমার কোনো ক্ষোভ থাকিবে না।

পরদিন প্রাতঃকালে আমি খলিফার নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সে লোকটি কোথায়, তাহাকে আনিয়াছ? এই বলিয়া, তিনি ঘাতককে ডাকাইয়া, প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন। তখন আমি তাঁহার চরণে পতিত হইয়া বিনীত ও কাতর বচনে বলিলাম, ধর্মাবতার, ঐ ব্যক্তির বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। অনুমতি হইলে সবিশেষে সমস্ত আপনাকে গোচর করি। এই কথা শুনিবামাত্র তাঁহার কোপানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি রোষরক্ত নয়নে বলিলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, যদি তুমি তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া থাক, এই দণ্ডে তোমার প্রাণদণ্ড হইবে। তখন আমি বলিলাম, আপনি ইচ্ছা করিলে, এই মুহূর্তে আমার ও তাহার প্রাণদণ্ড করিতে পারেন তাহার সন্দেহ কি। কিন্তু আমি যে নিবেদন করিতে ইচ্ছা করিতেছি, কৃপা করিয়া তাহা শুনিলে আমি চরিতার্থ হই।

(৩)

এই কথা শুনিয়া খলিফা উদ্ধত বচনে বলিলেন, কী বলিতে চাও, বল। তখন সে ব্যক্তি ডেমাস্কাস নগরে কীরূপে আশ্রয়দান ও প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন এবং এক্ষণে তাহাকে ছাড়িয়া দিতে চাহিলে, আমি অবধারিত বিপদে পড়িব, এ জন্য তাহাতে কোনোমতে সম্মত হইলেন না, এই দুই বিষয়ে সবিশেষ নির্দেশ করিয়া বলিলাম, ধর্মাবতার, যে ব্যক্তির এরূপ প্রকৃতি ও এরূপ মতি, অর্থাৎ যে ব্যক্তি এমন দয়াশীল, পরোপকারী, ন্যায়পরায়ণ ও সদ্বিবেচক তিনি কখনই দুরাচার নহেন। নীচপ্রকৃতি পরহিংসুক দুরাত্মারা, ঈর্ষাবশত অমূলক দোষারোপ করিয়া তাহার সর্বনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছে, নতুবা যাহাতে প্রাণদণ্ড হইতে পারে, তিনি এরূপ কোনো দোষে দূষিত হইতে পারেন, আমার এরূপ কোধ ও বিশ্বাস হয় না। এ ক্ষেত্রে আপনার যেরূপ অভিরুচি হয় করুন।

খলিফা মহামতি ও অতি উন্নতচিত্ত পুরুষ ছিলেন। তিনি এই সকল কথা কর্ণগোচর করিয়া কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর প্রসন্ন বদনে বলিলেন, সে ব্যক্তি যে এরূপ দয়াশীল ও ন্যায়পরায়ণ ইহা অবগত হইয়া আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইলাম। তিনি প্রাণদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইলেন। বলিতে গেলে তোমা হইতেই তাহার প্রাণরক্ষা হইল। এক্ষণে তাহাকে অবিলম্বে এই সংবাদ দাও ও আমার নিকটে লইয়া আইস।

এই কথা শুনিয়া আহ্লাদের সাগরে মগ্ন হইয়া আমি সত্বর গৃহে প্রত্যাগমনপূর্বক তাঁহাকে খলিফার সম্মুখে উপস্থিত করিলাম। খলিফা অবলোকনমাত্র, প্রীতি-প্রফুল্ললোচনে, সাদর বচনে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, তুমি যে এরূপ প্রকৃতির লোক তাহা আমি পূর্বে অবগত ছিলাম না। দুষ্টমতি দুরাচারদিগের বাক্য বিশ্বাস করিয়া অকারণে তোমার প্রাণদণ্ড করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম। এক্ষণে ইহার নিকটে তোমার প্রকৃত পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় প্রীতিপ্রাপ্ত হইয়াছি। আমি অনুমতি দিতেছি, তুমি আপন আলয়ে প্রস্থান কর। এই বলিয়া খলিফা তাঁহাকে মহামূল্য পরিচ্ছদ, সুসজ্জিত দশ অশ্ব, দশ খচ্চর, দশ উষ্ট্র উপহার দিলেন এবং ডেমাস্কাসের রাজপ্রতিনিধির নামে এক অনুরোধপত্র ও পাথেয়স্বরূপ বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া তাহাকে বিদায় করিলেন।

শব্দার্থ ও টীকা :

প্রত্যুপকার-উপকারীর প্রতি উপকার।
অভিরুচি-ইচ্ছা।
সমভিব্যাহারে-সঙ্গে নিয়ে।
নিষ্কৃতি-মুক্তি।
কোপানল-ক্রোধের আগুন।
প্রতীতি-বিশ্বাস।
পরিচ্ছদ-পোশাক।
প্রীতি-প্রফুল্ললোচনে-
বন্ধুত্বের অনুভূতিতে আনন্দিত চোখে।
মৌনাবলম্বন-নীরবতা পালন।
অব্যাহতি-মুক্তি, ছাড়া পাওয়া।
অবধারিত-নিণ্ডিত।
প্রত্যাগমন-ফিরে আসা।
রোষারক্ত নয়নে-ক্রোধে লাল চোখে।
অবলোকনমাত্র-দেখামাত্র।
সম্ভাষণ-সম্বোধন।
উৎকট-অত্যন্ত প্রবল, তীব্র।
অরুদ্ধ-বন্দি।
নিরীক্ষণ-মনোযোগ।
খলিফা-প্রতিনিধি। হযরত মুহম্মদ (স.)-এর পরে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান শাসনকর্তাকে খলিফা বলা হতো। তিনি একাধারে রাজ্যের প্রধান শাসক ও ধর্মনেতা ছিলেন।
ডেমাস্কাস-দামেস্ক। এশিয়ার একটি প্রাচীন শহর। হযরত ইব্রাহিমের (আ) যুগের পূর্বে এখানে শহর গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। পর পর এই শহরটি আবিসিনীয় ও পারসিকদের অধিকারে ছিল। শহরটি খ্রিষ্টপূর্ব ৬৪ অব্দে রোমানদের হস্তগত হয় এবং ৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থায়ীভাবে আবার শাসনাধীন হয়। বর্তমানে দামেস্ক সিরিয়ার রাজধানী।
মামুন-আল মামুন নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর পূর্ণ নাম আবুল আব্বাস আবদুল্লাহ আল মামুন (৭৮৬-৮৩৩) তিনি ছিলেন সপ্তম আব্বাসীয় খলিফা এবং হারুনর রশীদের দ্বিতীয় পুত্র। ৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও দর্শনের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চায় উৎসাহ দিতেন। তাঁর আমলে বাগদাদ শিল্পকলা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি বায়তুল হিকমাহ নামে সাহিত্য শিল্প একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আমলে প্রজাগণ অত্যন্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী ছিল।

বাগদাদ-ইরাকের রাজধানী, তাইগ্রিস নদীর উভয় তীরে এবং ফুরাত বা ইউফ্রেতিস নদীর পঁচিশ মাইল উত্তরে অবস্থিত। আব্বাসীয় খলিফা মনসুর ৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নগরটি প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা হারুনর রশীদের সময় বাগদাদ মুসলিম সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়। বর্তমানে ইরাকের রাজধানী।


 পাঠ পরিচিতি :

প্রত্যুপকার’ রচনাটি আখ্যানমঞ্জরী দ্বিতীয় ভাগ থেকে সঙকলন করা হযেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘আখ্যানমঞ্জরী’ রচিত হয় ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। বিশ্বের নানা দেশের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তির জীবনের গৌরবদীপ্ত ঘটনাই এ গ্রন্থের বিভিন্ন রচনার উপজীব্য। ‘প্রত্যুপকার’ আলী আব্বাস নামক এক ব্যক্তির প্রতি-উপকারের কাহিনী। খলিফা মামুনের সময়কালে দামেস্কের জনৈক শাসনকর্তা পদচ্যুত হন। নতুন শাসনকর্তা মামুনের একজন প্রিয়পাত্র ছিলেন আলী ইবনে আব্বাস। তিনি স্থানীয় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির আশ্রয়লাভ করে জীবন রক্ষা করেন। পরবর্তীকালে আলী ইবনে আব্বাসের আশ্রয়দাতা ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটি খলিফা মামুনের সৈন্যদল কর্তৃক বন্দি হন এবং খলিফার নির্দেশে আলী ইবনে আব্বাসের গৃহে তাকে অন্তরীণ রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আলী ইবনে আব্বাস বন্দি ব্যক্তির সঠিক পরিচয় জানতে পেরে উপকারীর উপকারের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ করেন এবং খলিফার কাছে তার মুক্তির জন্য সুপারিশ করেন। বস্তুত এ রচনায় দুজন মহৎ ব্যক্তির কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, এদের একজন নিঃস্বার্থ উপকারী, অন্যজন সকৃতজ্ঞ প্রত্যুপকারী। খলিফার মহত্ত্বও এ রচনায় প্রকাশিত হয়েছে।

অনুশীলনী

কর্ম-অনুশীলন

১. কোনো ব্যক্তি উপকারীর উপকার করেছেন এমন কোনো ঘটনা তোমার জানা থাকলে তা লেখ।

২. ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক রাজাকার উপকারীর বরং ক্ষতিই করেছে’-এরকম একটি ঘটনার বিবরণ দাও।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১।   খলিফা মামুন কোথাকার শাসনকর্তা ছিলেন?

ক.বাগদাদ

খ. ডেমাস্কাস

গ.সিরিয়া

ঘ. ইরান

২।   ‘পৃথিবীতে যত স্থান আছে ঐ স্থান আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়’- এখানে কোন্ স্থানের কথা বলা হয়েছে

i.  বন্দির জন্মস্থান

ii. ডেমাস্কাস নগর

iii.বাগদাদ

(৫)

নিচের কোনটি সঠিক?

ক.         i ii

খ. i iii

গ.         ii iii

ঘ.i, ii iii

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও:

সে বিস্ময়াবহ কাহিনী শুনিয়া নৃপতি মুগ্ধ হইলেন। বহুদিনের বিদ্বেষভাব দূরে গেল, ভক্তিতে অন্তর আর্দ্র হইল। প্রেমের জয় হইল। নৃপতির কণ্ঠে হাতেমের জয়গান। তাঁহার কণ্ঠ ভেদিয়া উত্থিত হইল’- ধন্য হাতেম, ধন্য তাহার কুল!

৩।নৃপতির মাধ্যমে ‘প্রত্যুপকার’ গল্পের খলিফার কোন্ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে?

ক.         বদান্যতা

খ. মহানুভবতা

গ.         দানশীলতা

ঘ. ঔচিত্যবোধ

সৃজনশীল প্রশ্ন

চুরির অভিযোগে কিছুলোক জনৈক ব্যক্তিকে চেয়ারম্যানের ইউনিয়ন পরিষদে হাজির করলো। ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি চৌকিদার আমজাদকে ডেকে নির্দেশ দিলেন বন্দিকে তার বাড়িতে রাখতে। ঘটনাক্রমে তিনি জানতে পারলেন বন্দি ব্যক্তি আর কেউ নয়, সে দশ বছর আগে আমজাদের সন্তানকে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়েছিল, নিজ গৃহে নিয়ে গিয়ে আহত সন্তানের সেবা করেছিল। কিন্তু আমজাদ নিজের ক্ষতি হবে ভেবে না চেনার ভান করে চুপ করে রইল।

ক.         বিদায়কালে খলিফা আল মামুন বন্দিকে কতটি অশ্ব উপহার দিয়েছিলেন?

খ.         খলিফা মামুন কিছুক্ষণ মৌন হয়ে ছিলেন কেন?

গ.         উদ্দীপকের বন্দির ঘটনা প্রত্যুপকার গল্পের কোন ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেন? ব্যাখ্যা কর।

ঘ.         আমজাদ ও আলী ইবনে আব্বাস উভয়ই বন্দি কর্তৃক উপকৃত হলেও এরা একে অপরের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেনি – বিশ্লেষণ কর।