Loading..

ব্লগ

রিসেট

০৯ মে, ২০২৪ ০৯:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মানবিক সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, যারা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তারা অবিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মানীয়। পিতামাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই; শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। শিক্ষকরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের হাত ধরেই মূলত আমরা জ্ঞানের মহাসাগর পাড়ি দেই। শিক্ষকরা প্রদীপের মতো নিজেকে জ্বালিয়ে অন্যকে আলো দান করেন, অর্থাৎ শিক্ষক অমর, তিনি বেঁচে থাকেন ছাত্রের আদর্শের মাধ্যমে। শিক্ষকরা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষা দেন তা নয়; তারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। একজন আদর্শ শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। এ কাজ ও দায়বদ্ধতা সহকর্মীদের কাছে, সমাজের কাছে, দেশ ও জাতির কাছে, আগামী প্রজন্মের কাছে। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। প্রত্যেক শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীর শিক্ষার প্রতি অনুরাগ জাগ্রত করা। শিক্ষার্থীদের অন্ধকার হতে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া এবং বাস্তব ও সত্য অনুসন্ধানে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। প্রত্যেক শিক্ষকের উদ্দেশ্য থাকা উচিৎ আদর্শ শিক্ষা বিলানো। সমাজের সাবির্ক অগ্রগমনের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আদর্শ জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকদের সর্বক্ষেত্রে মর্যাদা এবং মূল্যায়ন করা জরুরি। 

 

একটি মানবিক জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। আর শিক্ষকতা হচ্ছে একটি মহান পেশা। শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীন পেশাগুলোর একটি। ন্যায়-বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে শিক্ষকদের ভূমিকা অনন্য। সমাজের ভালো কাজ করার জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজন। জাতির ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে আর সেটা করবে একজন শিক্ষক। সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেটা রোধ করাও শিক্ষকদের দায়িত্ব। কেননা শিক্ষকরাই শিক্ষাথীর্দের ন্যায়-অন্যায়, সৎপথ, সঠিকপথের নিদের্শনা প্রদান করবে। সত্য-অসত্য, দেশের স্বার্থ এবং দেশের উন্নয়নের করণীয় সব বিষয়গুলো তাদের কাছে পৌছে দেবে একজন দায়িত্ববান শিক্ষক।

 

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড ও শিক্ষকরা হলেন এই মেরুদন্ড গড়ার কারিগর। যদি প্রশ্ন করা হয় একটি আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা বোধসম্পন্ন জাতি তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি? সবচেয়ে সঠিক জবাব হওয়া উচিত, শৈশবেই এর বীজ বুনতে হবে। নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা হবে এর ভিত্তি। আর শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি তথা প্রাথমিক শিক্ষাস্তর যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনমগজে ও ধ্যানে-জ্ঞানে আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, সততা, আচরণগত অভ্যাস, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করতে না পারে তা হলে কখনোই আদশর্বান জাতি গঠন করা সম্ভব নয়।

 

পরিবার থেকে বের হয়ে এসে একজন শিশু বিদ্যালয়ে ভতির্র মধ্যদিয়ে তার দ্বিতীয় পযার্য় শুরু করে। প্রথমপর্যায়ে মা-বাবা যেমন তার প্রথম শিক্ষা, এই পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা হন তার দ্বিতীয় মাতা-পিতা। প্রথম পর্যায়ে চার/পাচ বছরে পরিবার থেকে সে যা শিখে আসে, বিদ্যালয়ের সঙ্গে তার এক দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিদ্যালয়ে একটি শিশু শৈশবের দশটি বছর পার করে দিয়ে যৌবনে পা রাখে। অপরিণত বয়স থেকে পরিণত বয়সের দিকে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় একজন পরিপূণর্ মানুষ হওয়ার পথে। দ্বিতীয় পযার্য় সেই পর্যায়ে যখন একটি শিশু জীবনের অভিজ্ঞতার পৃষ্ঠা থেকে জ্ঞান আহরণের সঙ্গে সঙ্গে অথবা তার পরিবতের্ জ্ঞান লাভের জন্য অভিজ্ঞতাচ্যুত হয় এবং তা পাওয়ার জন্য বইপত্রের ওপর নিভর্রশীল হয়ে ওঠে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাত ধরে সে বইয়ের জগতে প্রবেশ করে। বড় কঠিন এই দ্বিতীয়পযার্য়। একজন শিক্ষাথীর্র স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সময় এটা। সেই জন্য এই পর্বে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তী কমর্জীবনের সাফল্য ও ব্যথর্তার ভিত্তি রচিত হয়ে যায় এই পর্বে।

চীনের প্রাচীন দাশির্নক কনফুসিয়াস বলেছেন- ‘শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক’। শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একজন শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। এ কাজ ও দায়বদ্ধতা সহকর্মীদের কাছে, সমাজের কাছে, দেশ ও জাতির কাছে, আগামী প্রজন্মের কাছে। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। মানবিক বিপযর্য় বা বৈশ্বিক, অথৈর্নতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অথৈর্নতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিমার্ণে শিক্ষকরা অবিরাম ভূমিকা রেখে চলেছেন। শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও। পিতা-মাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।

 

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী লুনাচারস্কি বলেছিলেন, শিক্ষক হলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে যুগ-যুগান্তরে সঞ্চিত যাবতীয় মূল্যবান সাফল্য হস্তান্তরিত করবেন, কিন্তু কুসংস্কার, দোষ ও অশুভকে ওদের হাতে তুলে দেবেন না। এটাই হলো শিক্ষকদের গুরুত্বের মাপকাঠি। মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু তাদের দিয়েই আমরা সুস্থ কুঁড়িগুলোকে লালন করতে পারি। আমেরিকার ইতিহাসবিদ হেনরি এডামস শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পকের্ বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেন, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়।

 

দার্শনিক বাট্রার্ন্ড রাসেল এ বিষয়ে বলেছেন, শিক্ষক সমাজ হচ্ছেন প্রকৃতই সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। তাই তো শিক্ষকদের বলা হয় ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ তথা সমাজ নিমার্ণের স্থপতি। সমাজের সাবির্ক অগ্রগমনের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও শিক্ষকের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ভালো শিক্ষক এর যে সব গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়- অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের মন বুঝতে হবে। নিজের শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। কারণ নিজের শেখার আগ্রহ না থাকলে ছাত্রছাত্রীদের শেখার আগ্রহ তৈরি করতে পারবেন। আচার-আচরণে ভদ্র হতে হবে। মিশুক হতে হবে। সততা অপরিহার্য। নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। ধৈযর্শীল হতে হবে। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত দুই ধরনের মানুষের প্রয়োজন কখনই শেষ হবে না- শিক্ষক ও চিকিৎসকের। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। পৃথিবী সম্পর্কে বুঝতে শেখে শিক্ষকদের কাছে। তারা জ্ঞানশূন্য মানবশিশুকে ভিন্ন চোখে বিশ্ব দেখতে শেখায়, প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে।’ -সুরা বাকারা : ২৬৯

 

শিক্ষকতা একটা ধর্ম, একে জীবনে ধারণ করতে হয়; জ্ঞানীমাত্রই শিক্ষক নন। মাদকমুক্ত, সমাজ গঠনে শিক্ষদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষকরাই পারেন একটি সমাজকে মাদকমুক্ত করতে। এটি শুধু আইন প্রয়োগ করে সম্ভব নয়। বতর্মান সরকার মানসম্মত শিক্ষা অজের্নর জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের দেশে এজন্য শিক্ষার হার শতকরা ৭২ ভাগে দাঁড়িয়েছে। আজকের তরুণ শিক্ষাথীর্দের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলে জাতি গঠনে কাজে লাগাতে হবে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বদ্ধপরিকর। আগামী ২০৪১ সালে আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। জাতি গড়ার কারিগরদের মূল্যায়ন ছাড়া সুশিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমরা যদি শিক্ষকদের মূল্যায়ন না করি, শিক্ষকদের মযার্দা সম্পকের্ সচেতন না হই তাহলে সুশিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।’

 

সেই পরিবতের্নর অভিভাবকত্ব শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব। সমাজের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট থাকা, সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞানতাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণি কক্ষে আগ্রহী পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আন্তরিক। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মাননিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারী, পথপ্রদশর্ক। অবশ্যই সৎ ও ধামির্ক। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নিমর্ল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী। সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতামনস্ক বিচক্ষণ সমাজ সংস্কারক। শিক্ষক হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন, পরিশ্রমী, নিরপেক্ষ, হাস্যোজ্জ্বল, সুপরামশর্ক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সরকার শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে তাদের সবাির্ধক মযার্দার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। কারণ যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। তাই কোনো জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য শিক্ষকদের মযার্দা দেয়া প্রয়োজন। বতর্মান সরকার শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধিসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে শিক্ষকদের সবোর্চ্চ মযার্দায় অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। ন্যায়-বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সৎ মানুষ, শিক্ষিত মানুষ ও জ্ঞানী মানুষের। সোনার বাংলা বিনিমার্ণ সময়ের দাবি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। শিক্ষকমন্ডলী যারা আগামীর জন্য মানুষ সৃষ্টি করেন তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। একজন শিক্ষকই পারেন একজন সুন্দর ও জ্ঞানী মানুষ তৈরি করতে। মানুষ যদি জ্ঞানী না হয় এবং জ্ঞানসমৃদ্ধ না হয় তাহলে সমাজের কোনো কাজে আসতে পারে না।

 

শিক্ষক হলেন জনগণের প্রদীপ। দেশের স্তম্ভ। আগামী আদর্শ প্রজন্ম তৈরি করতে আদর্শ শিক্ষকের জুড়ি নেই। ব্যক্তিগত জীবনে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনে শিক্ষকের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষকতা শুধু পড়ানোর নাম নয়, চিন্তা, চেতনা, নৈতিকতা সংশোধনের নাম। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে আমি প্রেরিত হয়েছি।’ -ইবনে মাজাহ: ২২৫

কোনো জাতির মান নির্ভর করে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের মানের ওপর। আর নাগরিকের মান বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষার মানের ওপর, আর শিক্ষার মান সম্পূর্ণই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতা ও গুণাবলীর ওপর। আদর্শ শিক্ষকই জাতিকে উপহার দিতে পারেন-সৎ, যোগ্য, আদর্শ ও চরিত্রবান নাগরিক। মানব সন্তানকে মনুষ্যত্ববোধে জাগিয়ে তুলতে হয় একজন শিক্ষককে। এইজন্য সকল স্তরের শিক্ষকদের করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। নরম কোমল হাতে চক-খড়ির মাধ্যমে শ্লেটে বর্ণ লিখতে শিখানো থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দান করতে শিক্ষকদের অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়। যে কাজটি মোটেই সহজ নয়। শিক্ষকের লব্ধজ্ঞান সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার নামই শিক্ষকতা। এজন্য শিক্ষক যতই জানুন না কেন, যদি তিনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তবে তার জানাটা এখানে অনর্থক ও মূল্যহীন হয়ে যায়। 

 

একটি উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার ভূমিকা, গুরুত্ব এবং তার প্রমাণ লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। যে জাতি বা দেশের শিক্ষার অবকাঠামো ও শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ যত উন্নত, দেশ ও জাতি হিসেবে সে জাতিই উন্নত ও স্বয়ংসম্পন্ন। শিক্ষক ও মা-বাবার অবদান অস্বীকার করে, এমন একজনকেও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মা-বাবা যেমন সন্তানদের ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দিয়ে বড় করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার আলো দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা তো বটেই। তাদের শিক্ষার আলো যেমন শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা তাদের অনুপ্রাণিত করে। সবাই ভালো ছাত্র হয় না, তবে সবাই ভালো মানুষ হতে পারে। শিক্ষার লক্ষ্য হলো ভালো মানুষ তৈরি করা। শিক্ষক নিজে মানুষ হিসেবে কতোটা আদর্শবান ও ভালো তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে কিনা। শিক্ষকতার পেশায় নৈতিকতা খুবই জরুরি।

 

এ ছাড়া নীতি-নৈতিকতা বোধ জাগ্রত না হলে কারো পক্ষে এ মহান পেশায় থাকা ঠিক নয়। আসলে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কটা হলো আত্মিক। ছাত্রের দেহ, মন ও আত্মার বিকাশ সাধনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর এজন্য শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক হবে নির্ভরতার। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর পরমবন্ধু, উপযুক্ত পথ প্রদর্শক এবং বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ দার্শনিক। কোনো কঠিন বিষয়কে সহজভাবে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করা শিক্ষকের একটা বড়গুণ। শিক্ষার্থীর ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করা; শিশুকে তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পাঠদান করানোসহ নিজেকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের সন্তান মনে করে সবার সাথে সমান আচরণ করতে হবে। একটি জাতির, সভ্যতার প্রধান মাপকাঠি শিক্ষা।

 

শিক্ষাকে তাই যুগে যুগে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে সকলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, শিক্ষকরাই জাতির মেরুদণ্ড। কথাটি যথার্থ, সময়োপযোগী ও ন্যায়সঙ্গত মনে হলেও প্রশ্ন থাকে কোন শিক্ষক? অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক। যার লক্ষ্য হবে আদর্শ মানুষ তৈরি, আদর্শ নাগরিক তৈরি; যার লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীর দেহ, মন ও আত্মার পূর্ণ বিকাশ সাধন করা। নিজেকে সত্য ও সঠিক পথে চলার যোগ্য করে তোলার পাশাপাশি নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য প্রস্তুত করতে হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীদেরও বলতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষকই জাতির মেধা গড়ার কারিগর। তাই তাকে হতে হবে আর দশটি মানুষের তুলনায় সেরা। একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হবে- ছাত্র-ছাত্রীদের যেকোনো সমস্যায় ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা। সব ধরনের পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। ছাত্র-ছাত্রীদের সত্যের পথে চালিত করা। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরি করা। কাজেই শিক্ষকদের কেন্দ্র করেই মানব সমাজের ক্রমোন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কাজেই শিক্ষক হলেন সমাজের কেন্দ্রবিন্দু।

 

শিক্ষক যে সমাজে বসবাস করেন, তিনি স্বাভাবিকই সে সমাজের একজন প্রতিনিধি। কারণ সমাজ ছাড়া মানুষ নেই, আবার মানুষ ছাড়া সমাজ গঠিত হতে পারে না। বর্তমান শিক্ষাকেন্দ্রে আধুনিক ভাবধারা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের কাজ ও দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে শিক্ষকদের কর্মক্ষেত্র শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমগ্র সমাজ পরিবেশেই তার কর্মক্ষেত্র সুবিস্তৃত। একজন আদর্শ শিক্ষক প্রথমে একজন মানুষ। তারপর একজন পেশাজীবি এবং মহান পেশাজীবি এবং বুদ্ধিজীবিও। আমাদের দেশে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা এবং সম্মান পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় অতি নগণ্য। এদেশে শিক্ষকতার প্রতি বয়োজ্যেষ্ঠদের এমন অনীহা প্রকাশ পেয়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ শিক্ষকদের বেতন ভাতায় আকর্ষণীয়তা বলতে কিছু নেই। ফলে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান অতি নিম্ন। যারা ভালো শিক্ষার্থী এবং প্রতিভাধর তারা অন্য চাকরিতে নিজকে সম্পৃক্ত করেন, শিক্ষকতায় নয়। পৃথিবীতে এখন সব দেশে শিক্ষকদেরকে সম্মানজনক আসন এবং মর্যাদাপূর্ণ সম্মানী দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও শিক্ষকদেরকে সম্মান এবং মর্যাদা দিতে হবে, তবেই শিক্ষকতায় আকর্ষণ সৃষ্টি হবে।

 

৫০ বছরের ইতিহাসে ধনদৌলতে, বিলাসে, অবস্থানে, জীবন যাপনে পার্থক্য বেড়েছে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির। উপরে উঠেছে মানুষ নিচের দিকে নেমে গেছে অধিকাংশ। এ বৈষম্য শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রচণ্ডভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। একাত্তরের যুদ্ধে, জাতি এক হয়েছিল একটি অভিন্ন লক্ষ্যে। আমাদের তেমন সমাজ গঠিত হয়নি। রাষ্ট্র সাহায্য করেনি বিকশিত জাতি গঠনে। শিক্ষাও তাই সাহায্য করেনি জাতি গঠনে। কেননা শিক্ষাও চলে রাষ্ট্রক্ষমতার ইচ্ছানুসারে। শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি বিষয়, কেননা আজকের শিক্ষাই আগামী দিনের বাস্তবতা। শিক্ষার উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষকের উন্নয়ন ছাড়া সর্বজনীন শিক্ষা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ও কলেজের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের বেতন ও মর্যাদা যুগ্মসচিবের সমান হবে। এটা বড়ই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড কাক্সিক্ষত বিষয়। মূল কথা হচ্ছে, শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণ ও ভবিষ্যৎ মানবিক সমাজ নির্মাণ সম্পর্কযুক্ত। তাই শিক্ষকদেরকে নৈতিক ও আর্থিকভাবে মর্যাদা দিয়ে নেতৃত্ব ও উন্নত মূল্যবোধ সৃষ্টি করে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা নির্মাণ সম্ভব। 

 

শিক্ষকতা হচ্ছে একটি মহান পেশা এবং পৃথিবীর সকল পেশার সেরা পেশা। শিক্ষকরা হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও। পিতা-মাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই; শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। শিক্ষকরা স্বমহিমায় বিশুদ্ধ জ্ঞান, মানবিক আর নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং দিক্ষীত করে গড়ে তুলেন দেশের যোগ্য নাগরিক। শিক্ষা যেহেতু জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষকরা হচ্ছেন এই মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর। এ সমাজের মধ্যে নৈতিক বিচারে শিক্ষকদের চেয়ে সম্মানিত এবং শিক্ষকতার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা দ্বিতীয়টি নেই। শিক্ষকরা এ সমাজের প্রাণ। পৃথিবীতে যে যত মহৎ হোক না কেন, সে কোনো না কোনো শিক্ষকের অধীনে জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাই পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে এসব পেশার মধ্যে শিক্ষকতা সর্বোচ্চ সম্মানিত পেশা। একজন শিক্ষক সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র।

 

মা-বাবা যেমন সন্তানদের ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দিয়ে বড় করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার আলো দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা তো বটেই; তাদের শিক্ষার আলো যেমন শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা তাদের অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষকে সভ্য হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেন। শিক্ষক ও মা-বাবার অবদান অস্বীকার করে, এমন একজনকেও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 

শিক্ষক সম্পর্কে উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড যথার্থ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন, একজন সাধারণ শিক্ষক বক্তৃতা করেন, একজন ভালো শিক্ষক বিশ্লেষণ করেন, একজন উত্তম শিক্ষক প্রদর্শন করেন, একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন। আমেরিকার ইতিহাসবিদ হেনরি এডামস শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেন, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়। দার্শনিক বাট্রার্ন্ড রাসেল এ বিষয়ে বলেছেন, শিক্ষক সমাজ হচ্ছেন প্রকৃত সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। এ কারণেই শিক্ষকদের বলা হয় সমাজ নির্মাণের স্থপতি। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী লুনাচারস্কি বলেছিলেন, শিক্ষক হলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে যুগ-যুগান্তরে সঞ্চিত যাবতীয় মূল্যবান সাফল্য হস্তগত করবেন, কিন্তু কুসংস্কার, দোষ ও অশুভকে ওদের হাতে তুলে দেবেন না তাই পাঠ্যক্রমটি নিতান্তই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, কিন্তু আন্তরিকতা একটি ক্রমবর্ধমান উদ্ভিদ এবং একটি শিশুর আত্মার জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।


মানুষ প্রাকৃতিকভাবে মূর্ত ও প্রত্যক্ষ নমুনা দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়। পঠিত বই বা শ্রুতবাণী দ্বারা তেমন প্রভাবিত হয় না। আর একজন ছাত্রের সামনে মূর্ত নমুনা হলো, তার আদর্শ শিক্ষক। তার মন-মানসিকতা গঠন ও পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। ছাত্র প্রথমে শিক্ষককে দেখে এবং নিজের অজান্তেই তার অনুসরণ করতে থাকে। পিতা মাতা ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা ছাত্রের জন্য কর্তব্য। পিতা-মাতা ও শিক্ষকের মাধ্যমে ছাত্ররা খুঁজে পায় ভবিষ্যতের পথ। তাই একটি মানবিক সমাজ গঠনে যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখতে পারে শিক্ষক। তাই শিক্ষা গুরুকে শুধু জাতি গঠনের কারিগর না বলে মানবিক সমাজ গঠনের কারিগর বলা হলেই তা যথার্থ শোনায়।